Saturday, November 11, 2017

সোনায় মুড়ে


ঝিঁঝি পোকার ডাক পছন্দ করেন না, এমন লোকের দলেই পড়েন বিকাশ বাবু। নভেম্বরে র দ্বিতীয় শুক্রবার, ব্যাঙ্ক এর কাজ জলদি মিটিয়ে বাড়ি ফেরার চক্করে সবাই। কিন্তু বিকাশ বাবু ক্যাশিয়ার, পাই টু পাই না মিলিয়ে বেরোনোর বান্দা নন, একটু দেরি ই হয়েগেল। খেলাপপুরের মতো এত ভেতরের দিকে গ্রাম থেকে পাঁশকুড়া স্টেশন পৌঁছানোই ঝামেলা। অন্তত কাছের বাসটেন্ড অব্দি কিভাবে পৌঁছানো যায়, ব্যাঙ্ক বন্ধ করে এইসব ই ভাবছিলেন। এমন সময় একটা ঝকঝকে টোটো নিয়ে উপস্থিত হরিয়া, ফিক ফিক করে বিড়ি টানছে। হরিশচন্দ্র দলাই কে ভালো নামে কেউই প্রায় জানেনা, একশো দিনের কাজের টাকা এসেছে কিনা জানতে প্রতি মাসে প্রায় একশবার ব্যাংকে আসে, তাই বিকাশ বাবুর চেনা।
--কি স্যার, কোথায় যাবেন? স্টেশন?
-- হ্যাঁ রে, তুই যাবি?
--নাহ, ওই বাসস্ট্যান্ড অব্দি যাবো, যাবেন?
---অন্ধের কিবা দিন কি বা রাত, চল চল।
---দাঁড়ান, আরেক টা বিড়ি ধরাই,
আরামসে দু টান মেরে টোটো চলতে শুরু করল, লালনীল এল ই ডি, কিশোরকুমার বাজছে, আর ধানক্ষেতের মাঝখান মোরামে চলছে টোটো। পাঁচ দশ মিনিট সব চুপচাপ, হটাৎ হরিয়া বলে উঠলো
--আপনার টেবিলে স্যার ওই ছবি তে বাচ্চাটা আপনার ছেলে না?
--হ্যাঁ, কেনরে?
আবার চুপ হরিয়া, বিকাশবাবু মোবাইলে  ব্যস্ত হয়ে পড়লেন । খানিক বাদে হরিয়া বললো,
--কত বয়স স্যার আপনার বাচ্চার?
--- এগারো মাস হলো, কেনরে?
আবার চুপ হরিয়া, এবারে মেজাজ হারালেন বিকাশবাবু,
-- এই শোন, যদি আমি প্রশ্ন করলে উত্তর না দিস তাহলে আর খবরদার আমাকে প্রশ্ন করবি না, চুপচাপ বাসস্ট্যান্ড এ নামিয়ে পয়সা চাইবি।
-- রাগবেননি স্যার, আমার ও ছেলের বয়স এগারো মাস।
--তো?
--- কিন্তু সে আমার কাছে নেই, আছে ,মানে অনেক দূরে আছে ।
-- কি খেয়েছিস সন্ধ্যে সন্ধ্যে, পাতা না তাড়ি??
-- না স্যার, বিড়ি ছাড়া আর কিছু টানিনা স্যার।
আচ্ছা তিন লাখ টাকা ব্যাঙ্কে রাখলে মাসে মাসে কত সুদ পাবো স্যার?
--- তোর মাথা টা কি পুরোটাই মায়ের ভোগে চলেগেছে??
-- নাহ স্যার, তবে কোনদিকে মন দিতে পারিনা আজকাল।
---কেন বলতো??
-- দু বছর আগে বিয়ে কবলাম, জানেন স্যার, পাশের গ্রাম। বউএর বাড়িতে মানেনি, পালিয়ে গিয়ে কালীঘাটে বিয়ে করলাম, তখন ভ্যান রিকশা ছিল।
-- তারপর? টোটো তে একটু এলিয়ে বসলেন বিকাশবাবু।
--গরিবের সংসার স্যার, রিকশা টেনে যা পাওয়া যায়। তবে বউ টা খুব ভালোবাসত জানেন। এই বছর একের মাসে ছেলে হলো, বউ টা বড় রোগসোগা ছিল স্যার, ওজন কম, কি বা খেতে দিতাম!! কোয়াক ডেকে বাচ্চা হলো। বাচ্চা হওয়ার দু হপ্তা বাদে বাড়িতেই মারা গেল ।বাচ্চা পাশেই শুয়ে, বিশ্বাস করুন স্যার, বাচ্চার     দিকেই তাকিয়ে ছিল, বোধহয় হাসছিল।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবার শুরু করল হরিয়া,
--নিজের বাপ মা অনেক ছোটবেলা থেকেই নেই।এক মাসি বেঁচে আছে, গেলাম নিয়ে ছেলেটাকে।তার অবস্থা আমার থেকেও খারাপ।কিন্তু আমাকে তো রোজ রিক্সা টানতে বেরোতে হবে বলুন,নইলে খাবো কি? মাসি কে বললাম শুধু দিনের বেলাটা দেখো, সন্ধ্যে নামলেই ফিরে আসবো।মা মরা ছেলে টা কে সেদিনের মতো নিয়ে নিলো জানেন স্যার। কিন্তু বেশি দিন রাখাগেল না জানেন, মাসির এক ছেলে, পাঁচ বছর বিয়ে হয়েছে ,এক টাও ছেলেপুলে আসেনি।কি রাগ আমার ওই এক রত্তি বাচ্চার উপর!! রাখতে দিলো না স্যার, নিয়ে চলে এলাম, আবার এর ওর তার বাড়ি। একদিন রাতে ছেলের কান্না সহ্য করতে না পেরে খুব জোরে  আট দশ টা চড় মারলাম। কচি পা দুটো যেন লাল হয়ে  ফেটে ফেটে গেল।আমাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরল জানেন স্যার।
---ওই টুকু শিশুকে তুই মারলি?
---ভীষণ রাগ  ধরে গেছিলো নিজের ওপর স্যার, কাতান দিয়ে নিজের হাত কেটে ফেলতে গেছিলাম। রতন দা দেখতে পেয়ে ছুটে এসে আটকায়। রতন দা কে চেনেন তো স্যার?
--হুঁ,---চাষের জমিজমার, কৃষি লোনের দালাল রতন কে  বিকাশবাবু ভালোই চেনেন।
---রতন পরের দিন সকালে আমার ছেলেকে তার বাড়িতে রাখতে নিয়েগেল। বৌদিও দেখবে বললো ।একটু নিশ্চিন্ত হলাম স্যার। কিন্তু সেটা কয়েক দিন।ক
---তারপর??
-- দিন দশেক যেতেই, এক রাতে রতন দা খেতে ডাকলো আমাকে, খেতে খেতে বললো,"তুই একা ওই টুকু বাচ্চাকে পারবিনা বড় করতে, ওকে যে মানুষ করতে পারবে তাকে দিয়েদে।" হাতের খাওয়ার আর মুখ পর্যন্ত পৌছল না স্যার।
--চিৎকার করে বললাম, "আমার ছেলে কে দিয়েদাও, এখুনি ।"
---নিয়ে যা, ওই ঘরে ঘুমিয়ে আছে,কিন্তু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখিস, তুই পারবি না ঐটুকু ছেলে কে এক মানুষ করতে। তিন কূলে  কে আছে তোর ? আবার বিয়ে করবি? কর। সৎমা দেখবে তোর ছেলে কে? নিজের অবস্থা দেখেছিস? আমার কথা শোন, আমার চেনা লোক আছে, বোম্বে থেকে আসছে পরশু। দিয়েদে। ফোকোটে নয়। নগদ পাঁচ লাখ পাবি। কোনোদিন স্বপ্নেও দেখেছিস হতভাগা??  জীবন পাল্টে যাবে।
---তুই, তুই নিজের ছেলে কে বেচে দিলি?
---সারারাত কাঁদলাম স্যার আর ভাবলাম ওরা কি আমার ছেলে কে ভালো রাখতে পারবে??, একদিন বাদে একটা বড় গাড়িতে করে এক স্বামী-স্ত্রী আর একজন আয়া এলো, হিন্দিতে কথা বলছিল।বড়লোক দেখেই বোঝাযায়।।  মোবাইল খুলে ছবি দেখে আমার ছেলেকে  মিলিয়ে নিলো। দেখি ভদ্রলোকের স্ত্রী একটা বিরাট ব্যাগ থেকে ধবধবে সাদা তোয়ালে বের করলো। তোয়ালের ভেতর দেখি অনেকগুলো সোনার চেন,আরো গয়না আছে।সবচেয়ে সুন্দর চেন টা আমার ছেলের গলায় পরিয়ে তাকে তোয়ালে জড়িয়ে কোলে তুলে আমাকে নমস্তে করলো। ভদ্রলোক রতন দার সাথে কথা বলছিলেন।এসে আমাকে বললেন, যখন ইচ্ছে হবে ছেলে কে দেখতে পাবে,একটাই শর্ত, পরিচয় দেওয়া যাবে না। পুরো নগদ দিয়েগেল স্যার।
--তোর পাড়ায় কেউ কিছু বললো না?
--- সারারাত ফিস্ট হলো স্যার পাড়ায়।সবাই আমার ভাগ্যকে আজ হিংসে করছে । এই টোটো টা কিনলাম। আর বাকি টাকা আপনার সিটের তলায় আছে।আপনি বলে বললাম। এই নিন স্যার, বাসস্ট্যান্ড এসেগেছে।
--- নিজের ওপর ঘেন্না করে না তোর?একটা কষ্ট যেন গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে বিকাশ বাবুর।
--জানিনা। খালি রাতে ঘুম আসে না। চোখ বুঝলেই দেখি ওরা আমার ছেলেকে নিয়ে চলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, সোনায় মুড়ে ।

Saturday, September 16, 2017

খুনসুটি

সারাদিন খাটা খাটুনির পর অফিস থেকে ফিরে একটু হাত পা ছড়িয়ে ফ্যান এর তলায় বসলো অসিত। লাস্ট দু সপ্তাহ খুব হেক্টিক গেছে। প্রমোশন তারপর বদলি, নতুন শহর, আবার একটা ঠিক ঠাক বাড়ী ভাড়ার জন্য খোঁজা, এক ঘর জিনিস পত্র সরানো, খুব ধকল যাচ্ছে। এইসব ভাবতে ভাবতে রেগুলেটর টা একটু বাড়াতে গেল অসিত, আর ব্যাস, লোডশেডিং।
---ধুর শালা, কপাল টাই খারাপ।
--" তাই হবে, তুমি আজও ইনভার্টার এর কানেকশন টা ঠিক করলে না, "...টর্চ নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠলো শ্রাবণী।
-- সারাদিন কাজের পর আর কিচকিচ করো না তো, আমারো তো একটা সীমা আছে নাকি, কতোদিক কত তাড়াতাড়ি সামলাবো ??
-- তুমি একাই সব সামলাও ?? সারাদিন ধরে আমি ঘরে থাকি বলে কি কিছুই করিনা বলতে চাও?একটা ছুটির দিন শুধু তোমার ছেলেটা কে ,এক বেলা সামলে দেখাও , বাকি ঘরের কাজ বাদ ই দিলাম ,তারপর মেজাজ দেখাবে।
দুঃস্বপ্নেও জেতা যাবে না, এরকম যুদ্ধে না নামাই ভালো। ডিসকভারি তে মাঝে মাঝেই দেখায় স্বয়ং বিশালাকায় সিংহ মামাও সিংহী র দাবড়ানি এর সামনে ল্যাজ গুটিয়ে বসে পড়ে, তো অসিত কোন ছারপোকা !!!
পাশের রুমে ছোটা শাকিল ততক্ষনে দুষ্টুমি ভুলে অন্ধকারে চিল চিৎকার জুড়েছে। প্রায়োরিটি সেট করা হয়ে গেল। শাউটিং কিড না ক্ষুব্ধ বউ । প্রথম টাই শান্ত করা জরুরি। চুপচাপ বাচ্চা কে কোলে করে ছোট্ট ব্যালকনিতে চলে যায় অসিত। আর দিন দুয়েক বাদেই পূর্ণিমা।অনেক টা চাঁদের আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। বউ চুপচাপ ব্যালকনির আরেক কোনে দাঁড়িয়ে। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অসিত হঠাৎ বলে উঠলো,
--- আমার চশমা কোন ক্লাসে লেগেছিল জানো??
-- না, তাতে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে?
-- তাও ঠিক। আচ্ছা, বাদ দাও।
‌খুব ই পুরোনো ট্রিক।কিন্তু দরকারে খুব কাজে দেয়।কিউরিওসিটির সলতে পাকিয়ে ছেড়ে  দাও।
--কি হলো, বলবে??
--- কি বলবো?
-- ন্যাকামো তুমিও কম করো না। তোমার চশমার গল্প।
-- ওহ, ওই টা কিছুনা।
-- তুমি বলবে,  হ্যাঁ কি না ?
--বলছি বলছি, আমার চশমা লেগেছিল ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে ওঠার সময়।লোডশেডিং এর জন্য।
-- মানে?
-- মানে আর কি? তখন তো আর ব্যাটারী, ইনভার্টার ছিল না, মানে আমার বাবা তখন ও এনে দিতে পারে নি। তো হারিকেন ই ভরসা।
-- তার সঙ্গে চশমার কি ??
-- কিছুই না, হোম টাস্ক ক্যান ওয়েট, চাচা চৌধুরী, বিল্লু, পিঙ্কি, সাবু , রাকা কান্ট। যত খুদে খুদে লেখাই হোক, যত কম আলোই হোক, পড়ে ফেলতেই হবে। আমাদের বাবু বোধহয় এই সব আর পড়বে না বলো,   বড়ো হয়ে??
-- কে জানে!!মোবাইল, কিন্ডল, ট্যাব কত কি এসেগেছে,বই হাতে নিয়ে পড়ার কি দরকার!! আমার চাঁদমামার একটা বিশাল কালেকশন ছিল জানো, পুজোতে বাপের বাড়ি গেলে পুরোনো আলমারি গুলো ঝেড়ে দেখতে হবে।
-- বা বা, তুমি এতদিন বলোনি তো?
--তুমিও কি বলেছিলে যে কমিকস পড়ে পড়ে তোমার চোখে চশমা লেগেছিল??
-- শোধবোধ, ওকে? তুমি হারিকেন এর কাচ পরিস্কার করে কেরোসিন ভরে ঠিক ঠাক জ্বালাতে পারবে? আমি পারতাম । কেরোসিনের একটা অদ্ভুত দারুন গন্ধ হয় , যেটা ছোট বেলায় কেন জানিনা খুব ভালো লাগতো। আমি মেঝেতে বসে হারিকেন ঠিক ঠাক ফিটিং করতাম, আর আর ঠাম্মা পান চিবোতে চিবোতে মাঝে মাঝে সেই সময় ই ভূতের গল্প বলতো। আজকাল আর কেউ গল্প বলে না বলো, সবাই গল্প ফরওয়ার্ড করে।
-- তাই হবে, এই সব বাজে কথা ছেড়ে উঠবে, বাচ্চা টা ঘুমিয়ে গেল যে!!
-- হ্যাঁ, এনাকে ন্যাপি পরিয়ে যথাস্থানে সেট করে দিতে হবে  দেখছি, একটু ধরো দেখি। এই দেখ,
 কারেন্ট ও এসেগেল। যাক বাবা , শান্তি ।
-- হ্যাঁ, তোমার ওই সব ভাট বকা থেকেও শান্তি দাও। তাড়াতাড়ি ডিনার টা সেরে আমাকে উদ্ধার করো।
-- তুমি না খুব আনরোমান্টিক, বুঝলে?
-- তুমিও না খুব  প্যাথেটিক  , কাল যেন ইনভার্টার টা লোক এসে সারিয়ে দিয়ে যায়, বুঝলে??



Monday, August 28, 2017

অথ শস্য কথা


‌"এমন বসন্ত দিনে, বাড়ী ফেরো মাংস কিনে, বারোয়ারি ডাস্টবিনে জমে ওঠে ....." গুনগুন করতে করতে বিভুবাবুর মনে হল ,ধুর শালা ,এটা তো অগাস্ট মাস, বসন্ত কোত্থেকে আসবে??বহুদিন বাদে একটা ক্যাজুয়াল লিভ মেরেছেন বিভুবাবু, এই বছরে এই প্রথম, গিন্নি খুশ, দারুন গন্ধ ভেসে আসছে রান্না ঘর থেকে। বিভুবাবু মহা অলস লোক, ছুটি নিয়ে সারাদিন বাড়িতেই থাকবেন, সারাদিনে কিছু না খেতে দিলেও পরোয়া নেই, ল্যাদ খেয়ে কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু, ভাগ্য এতটাও প্রসন্ন নয়, গিন্নির হুকুম, বসে বসে তো মোটা হচ্ছ, আনন্দবাজার চেবানো শেষ হলে যাও না একটু মাছ বাজারে, বৃষ্টি হচ্ছে, ভাবছি খিচুড়ি করবো, সঙ্গে তো কিছু লাগবে নাকি??

অগত্যা পাশের ফ্লাট এর অভি বাবু কে নিয়ে চললেন কোতোয়ালি বাজারে, অলস লোকেরা সাধারণত বুদ্ধিমান হয়, কাছের বাজার টা  অন্তত চিনে রাখতেই হয়।বাজারের শুরু থেকেই প্রত্যেক মাছ ওলার একটাই চিৎকার, "দাদা পাঁচশোর মাল চারশয়, শুধু আপনার জন্য সাড়ে তিনশোয়, আপনি তো রেগুলার নেন দাদা, আপনাকে আর কি বলবো!!" বিভূবাবু তিন মাস বাদে এই বাজারে এলেন।যাই  হোক, আরো এগিয়ে চললেন ।
অভি বাবু পোড়খাওয়া বিষয়ী মানুষ, প্রায় কাকার বয়সি, তার সাবধানবাণী ,"নিজে টিপে দেখে পরখ   না করে কিছু নেবে না, বৌমা বলেই দিয়েছে যে তোমার মতো ন্যলা কেবলা লোক বিরল, একটু দেখে কিনবে,"।  রাগে গা হাত পা জ্বলে গেলেও উপায় নেই। অভিবাবু এক জন প্রকৃতই শুভানুধ্যায়ী। সাত পাঁচ আর না ভেবে ইলিশ সমুদ্রে ডুব দিলেন বিভু বাবু। সরু ইলিশ, মোটা ইলিশ, রোগা ইলিশ ,চওড়া ইলিশ,বুড়ো ইলিশ, খোকা ইলিশ, দীঘার ইলিশ, কোলাঘাটের ইলিশ, পালিশ করা ইলিশ আবার বালিশের মতো ইলিশ। বিভু বাবুর চোখ বড়বড় হয়ে যাচ্ছে এটা ভেবে যে এই সবের ই সদগতি হবে, ঝোলে হবে, ঝালে হবে , অম্বলে বা টকে হবে , আরো চাইলে ভাপে হবে , দিবে শুধু  দিবে, মিলাবে মিলিবে , যাবে না কেহই ফিরে।

গোটা বাজার ঘোরা হয়ে গেল।এবার কিনতেই হবে, কানকোর ঠিক তলায় একটু টিপে দেখে নিলেন, নাহ, বেশ শক্ত পোক্তই মনে হচ্ছে, দাও ভাই এটাই কেটে দাও। ঠিক ঠাক পিস কোরো ভাই, নয়তো আমার  পিস নষ্ট হয়ে যাবে। অভি বাবু একটু বিজ্ঞের হাসি দিলেন,আর মনে মনে বললেন"আজকালকার ছোকরা, গুছিয়ে বাজার করার যে আনন্দ কতটা , কি আর বুঝবে!" ফিচকে মাছ ওলা ও কম যায় না, কাটতে কাটতেই বলে উঠলো," এমন মাছ দিচ্ছিনা দাদা, দেখবেন বৌদি নিজেই মাছ ছাড়িয়ে আপনাকে খাইয়ে দেবেন"। আর বিভুবাবুর ও মনে পড়ে গেল ঠিক বিয়ের আগের বছর এর কথা,দুই বাড়িতেই সব জানাজানি হয়েগেছে, খালি ডেট ফাইনাল করা বাকি,এমন সময় একদিন ডিনার এ নেমন্তন্ন হবু শ্বশুর বাড়িতে। খাসী মাংসের সাথে ইলিশের ঝাল ও আছে। ইলিশ পছন্দের মাছ হলেও কাঁটা টা ঠিক ম্যানেজ করতে পারেন না বিভু বাবু, তাই ইলিশ ভাজা ই বেশি পছন্দ। পড়ে গেলেন মহা  বেকায়দায়। হবু শালী দের সামনে, বউ এর মাসী দের সামনে চূড়ান্ত কেস খাওয়া। অবশেষে উদ্ধারে সেই অর্ধাঙ্গিনী  । প্রতিজ্ঞা করেছিলেন বিভুবাবু যে পরের জামাই ষষ্ঠী তে দেখিয়ে দেবেন যে তিনি কত এক্সপার্ট কাঁটা ছাড়াতে , দরকার হলে কাঁটা চামচ দিয়েও কাঁটা ছাড়ানো শিখে নেবেন।

সাত বছরের পুরোনো ছেলেমানুষির কথা ভেবে নিজেই একটু হেসে নেন । ইলিশ ততক্ষণে মাছের ব্যাগ এ ঢুকে পড়েছে। তারপর পকেট হালকা আর মন আনন্দে পূর্ণ করে , অভি বাবুর দিকে তাকিয়ে  বিভু বলেন,"চলুন দাদা ,এবার বাড়ি ফেরা যাক"  ....

Saturday, July 8, 2017

ক্যারম

~~"আমি ডান দিকের সিঁড়িটা দিয়ে উঠে যাচ্ছি অনীশ, তুই আমাকে কভার কর,"হিস হিসিয়ে কথাটা বলেই নিঃশব্দে উঠেগেল রোহিত।জার্মান মাউজার এর লক টা আরেকবার দেখেনিল অনীশ।এরকম কভার্ট অপারেশন নতুন নয়,আট বছর হয়েগেলো ফোর্স এ ,তবুও বেসিকস ঠিক  রাখতেই হয়। পাক্কা ইনফরমেশন আছে, কিছু এক্সট্রিমিস্ট এই বিল্ডিং এরই পাঁচ তলায় আছে।আরেক টা ফ্লোর উঠে ডান দিকে ঘুরতেই কপালে জোর একটা আঘাত, তারপর ই সব ব্ল্যাক আউট।

জ্ঞান ফিরতে দেখলো, ওপর থেকে ঝুলিয়ে রাখা আছে তাকে।লোহার রড লাল  করে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে অনীশ এর দিকে, দাতে দাঁত চেপে অনীশ অপেক্ষা করতে থাকলো টর্চারের। মরে যাবে তবু মুখ খুলবে না,এ ট্রেনিং নেওয়া আছে,আজ পরীক্ষার দিন।রোহিত  টা যে কোথায় গেল!!!আবার যখন জ্ঞান ফিরলো,আর্মি হসপিটাল এ শুয়ে আছে অনীশ।খালি কোমরের তলায় সাড় নেই।ডাক্তার বলেগেলেন ,"সরি ফর ইওর লস মাই ব্রেভ সন, ইউ ডিড এ গ্রেট সার্ভিস টু ইওর কান্ট্রি,ইওর ফোর্স"!!! ম্লান হাসি খেলে গেল অনীশ এর মুখে।ওই তো একটা খালি হুইল চেয়ার নিয়ে ঢুকছে রোহিত আর   রিয়া। হৃদপিন্ড টা যেন এক সেকেন্ড এর জন্য থমকে গেল ,তবে কি যা শুনেছিল সবই সত্যি !!! ব্যথার ভান করে চোখ বুজল অনীশ।আর কারুর কোনো কথাই শুনতে ইচ্ছে করছে না।

এক বছর কেটে গেছে।রোহিত এর প্রতিপত্তি, লিডারশিপ এবিলিটি তে সবাই মুগ্ধ।সবচেয়ে বড় কথা , ডিরেক্ট কমব্যাট থেকে ট্রান্সফার হয়ে টেক ডিপার্টমেন্ট এর হেড অনীশ অব্দি তার সাপর্টে, রোহিতের চিফ অফ ডিপার্টমেন্ট হওয়া আটকায় কে? টেক ডিপার্টমেন্ট এর ছোট্ট ঘরটাই অনীশ এর সব।অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়াও রয়েছে একটা বিরাট ম্যাচ বোর্ড, ক্যারম এর। ইউনিভার্সিটি চ্যাম্পিয়ন ছিল অনীশ।এখনো ক্যারম এর স্ট্রাইকার তার নিঃসঙ্গতাকে ভরসা দেয়।শুধু রোহিত কে সে টাচ করতে দেয় ওই বোর্ড টা। আজ একটা অপারেশন এর পর ফিরলো রোহিত,শুট এট সাইট এনকাউন্টার অর্ডার ছিল। একটা গুলি ডান হাত ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে।ছুটতে ছুটতে ঢুকে পড়লো, অনীশ এর চেম্বার এ।জামাখুলে ব্যাণ্ডেজ বাঁধতে বসলো।অনীশ চুপ চাপ গুটি সাজাচ্ছিলো বোর্ডে।দেখলো নতুন ট্যাটু করিয়েছেন রোহিত বাবু,ডান কোমরের কাছ থেকে পেট অব্দি সিংহের মুখ।সিক্স প্যাক চেহারায় ভালোই খুলেছে ব্যাপার টা।ম্যাচ শুরু হতেই মুচকি হেসে অনীশ বলল,"একটা পুরোনো সমস্যা সলভ হয়েছে।জেনে গেছি আমাকে সেই টর্চারের পেছনে কে ছিল। মুড ভালো আছে, তোকে আজ সেঞ্চুরি বোর্ড মারবো।বলেই স্ট্রাইক।হিটে ই চার গুটি গেল। লাস্ট গুটি টা ফেলার সময় দেখলো ঠিক অপজিট এঙ্গেলে বোর্ডের ডায়াগোনালি দাঁড়িয়ে রোহিত, মুখ হাঁ করে দেখছে জিনিয়াস অন হুইলস এর খেলা।অনীশ বলল,রোহিত ঐখানেই দাড়া, তোকে চটকা শট দেখাই।বলেই ডান হাতের মধ্যমা আর বুড়ো আঙ্গুল এরমাঝে স্ট্রাইকার বসিয়ে অদ্ভুত ভাবে একটা হিট করলো নিজের বেসে এ।স্ট্রাইকার কোনাকুনি ছিটকে গিয়ে রোহিতের সামনের পকেটে গিয়ে ফেলেদিল শেষগুটি।এক মুহূর্তের জন্য যেন চিনচিনে ব্যাথা পেলো রোহিত, পর মুহূর্তেই সব ঠিক।আস্তে আস্তে খালি বোর্ডের উপরে একটা কার্ড রাখে রোহিত।তার আর রিয়া এর বিয়ে।প্রথম ইনভাইট অনীশ কে।পুরোনো স্মৃতি যেন চলকে ওঠে চোখের সামনে।বেস্ট উইশ জানিয়ে অল্প হাসে অনীশ।পরের দিন সকালেই খবর আসে অফিস এ। নিজের বাথরুমের ভেতর রোহিতের ডেড বডি পাওয়া গেছে। পোস্টমর্টেম এ জানা যায় বিষক্রিয়ায় মৃত্য।তার মোবাইল ট্র্যাক করে দেখাগেল এনকাউন্টার এর পরে  অনেকগুলো বার এ সেই রাতে রোহিত ঢুকেছিলো অফিস ফেরার আগে।নেশা হিসেবে মাঝে মধ্যে ইনজেকশন নিতো রোহিত, বাঁ হাতে ইনজেকশন এর দাগ ও ছিল।গোটা শরীর  জুড়ে ট্যাটু।সেটাই কি কাল হলো??

আরও ছয়মাস কেটে গেল।নতুন চিফ অফ ডিপার্টমেন্ট এর ট্রান্সফার এর জন্য ফেয়ার ওয়েল নিচ্ছে অনীশ।মুম্বাই চলে যাচ্ছে সে।হুইলচেয়ার তার কাজের ক্ষেত্রে উন্নতিতে বাধা হতে পারেনি। সবাই কে ধন্যবাদ জানিয়ে সে বললো যে সে চলে যাওয়ার পর যেন তার বন্ধুর স্মৃতিতে ওই ক্যারম বোর্ডে আর কেউ না খেলে।পাতলা প্লাষ্টিক কভার একটা চাপিয়ে চলে যায় সে।

নতুন বাচ্চা সুমিত  জয়েন করেছে। সে নাকি দারুন ক্যারম খেলে।সবাইতাকে পুরনো গল্প শোনায়। থাকতে না পেরে একদিন   সেই বোর্ডের কভার খুলে সে  আনমনে  হাত বুলোতে থাকে।এত সুন্দর পালিশ করা ম্যাচ বোর্ড।আর কেউ খেলে না এটায়! কি দুর্ভাগ্য! হটাৎ ই একটা পকেটের পাশে হাত দিতেই মনে হয় কেউ যেন  একটা চিমটি কাটলো । সুইচ টা দেখতে পায়নি সুমিত ,যেখানে বলে বলে হিট করতো অনীশ এর স্ট্রাইকার, বিষ মাখানো নিডল টা চোখের পলকে বোর্ড এর সেই পকেটের বাইরের দিক থেকে বেরিয়ে সুমিতের ডান কোমরে ছুঁয়ে আবার ভেতরে ঢুকে যায় ~~~~~



Sunday, June 25, 2017

প্রসাদের থালা

আমি বল্টে, বয়স চোদ্দ, রোগাটে গড়ন, গায়ের রং কালো, আর বয়সের তুলনায় একটু লম্বা আর একটু পাকা, বরেন কাকু বলে। রঘুনাথপুরের স্টেশনের ঠিক পেছনে বুড়ো বট তলার পূর্ব পাশেই বরেন  কাকুর দো তলা মাটির বাড়ি। জন্ম থেকে সেখানেই আছি। বরেন কাকুর তিনকুলে কেউ এখন আর নেই, আমারও  কেউ ছিল কিনা জানি  না। বছর কুড়ি আগেই একটা এক্সিডেন্ট এ বরেন কাকুর বউ,বাচ্চা,বাবা আর মা মারা যান। বরাতজোরে টিকে গেছিলো বরেন কাকু।আর বিয়ে করেনি।বাড়িটাকে একটা অনাথ আশ্রম বানিয়ে দিয়েছে।আমি ই এক নম্বর এই বাড়িতে।আরো আটজন আছে। বরেন কাকু আমাকে স্টেশনের ধারে রাখা একটা  ভাঙা ওয়াগোনের ভেতরে পেয়েছিল গামছা জড়ানো অবস্থায়।চারপাশে অনেক জং ধরা নাট বল্টু পড়ে ছিল।সেই থেকে  আমি বল্টে ।
এক নম্বর তাই একটু বেশি ভালোবাসে।কি যেন বলল,হ্যাঁ, আমাকে দত্তক নিয়েছে, নাম দিয়েছে অজয়, আমার আধার কার্ড ও আছে। ক্লাস এইটে পড়ি আমি।পরশুদিন ক্লাসে ব্যাটারী নিয়ে এসেছিলেন ভৌতবিজ্ঞানের স্যার। বেশ মজার জিনিস শেখালেন।কাল স্কুল ছুটি, কাল তো রথ।এই রথের দিনগুলো বেশ মজা হয়, বরেন কাকু রথ এনে দেয় একটা ছোট্ট, আমরা সবাই মিলে সেটাকে সাজাই। রথ সাজানো কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়।রঙ্গিন কাগজ,সেলোটেপ, আঠা,কাঁচি আরো কত কি লাগে।
আমাদের পাড়ায় প্রতি বছর রথের মেলা হয়, রথ কম্পিটিশান হয়, একবার ও ফার্স্ট হতে পারিনি।এবারে ও চেষ্টা করতে হবে।শোলা কেটে নকশা ভালোই পারি, কিন্তু আলো নিয়েই মুশকিল,মোমবাতি ই ভরসা। কিন্তু এবারে ঠিক করেছি ব্যাটারী  আলো করবো।এভারেডি ব্যাটারী এনেছি বড় গুলো,তিন টে।একটার পর একটা পরপর লাগিয়ে ভালোকরে খবরের কাগজে এগ রোলের মতো পাকিয়ে নিয়েছি।এবার টুনি কিনে হোল্ডারে জুড়ে দিলেই হলো।লাল তার একদিকে আর অন্য দিকে কালো তার , আর পুরোটাকে আটকে রাখার জন্য গার্ডার। ব্যাস ,হয়েগেলো আলো।এইবারে প্রসাদ টাও ভালো করে করতে হবে, চানা, বাতাসা, কলা,শসা তো থাকবেই,ভাবছি নকুলদানাও দেবো।অনেক কষ্টে বরেন কাকুকে রাজি করিয়েছি।আসলে ধান্দা অন্য।আমি দেখেছি যে রথের মেলায় লোকে চারাগাছ ছাড়া আর কিছু কেনে না,ভালো রথের দিকে তাকিয়ে প্রশংসা করে বটে কিন্তু প্রণামী দেয় না, কিন্তু প্রসাদ পেলে কিছু না কিছু দেবেই। সেই টাকা জমিয়ে পরের দিন ফিস্ট করব।সেটাই মজা। সব্বাইকে আমার প্ল্যান বলে দিয়েছি।সবাই রাজি। বরেন কাকু কে বলিনি,খুব মারবে তাহলে।
টাকা ভালোই উঠছে, জগন্নাথ,বলরাম,সুভদ্রার কৃপায়।এমন সময় হঠাৎ ভীষণ ঝড় উঠলো,তারসাথে বৃষ্টি। সব যেন লণ্ডভণ্ড করেদেবে।সবাই পালাতে ব্যস্ত। একটাই মাত্র লোক তখন আমাদের রথের সামনে দাঁড়িয়ে,গম্ভীর মুখে আমাদের নাম কি,কোথায় থাকি জিগ্যেস করছে আর টকা টক প্রসাদ খেয়ে যাচ্ছে,প্রণামী দেওয়ার নাম ই নেই।আমরা তখন পালাতে পারলে বাঁচি।দুহাতে রথ টা জড়িয়ে দৌড় দিলাম আমি ।বাকিদের কেউ সামলাচ্ছে প্রণামী এর বাটি, কেউ প্রসাদের থালা। প্রচন্ড বৃষ্টি আর কড়কড় করে বাজ পড়ছে। সবাই আলাদা হয়েগেছি। রাত অনেক,ভয় ও করছে।অনেক দেরিতে যখন বাড়ি পৌঁছলাম,দেখি বরেন কাকু হ্যারিকেন হাতে বাইরের ঘরে পায়চারি করছে।আমাকে দেখে ,কান টা খুব জোরে পাকিয়ে দিয়ে বললো,"পালের গোদা হয়েছ? এক চড়ে পিঠ ফাটিয়ে দেব তোর, এতগুলো বাচ্চা কে নিয়েগেছিস,কোনো আক্কেল আছে?" কোনোমতে চোখের জল সামলে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লাম।প্রসাদের থালা, প্রণামী এর বাটি,সব হারিয়ে গেছে,রথ টা  এক কোণে রেখে প্রনাম করে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে রোদ উঠেছে,আমাদের মন ও আকাশের মতো ঝকঝকে হয়ে উঠেছে।পান্তা,আলুমাখা আর কাঁচালঙ্কা খেতে খেতে বললাম,"জানো বরেন কাকু,আমাদের ফিস্ট ও গেলো, প্রণামী এর বাটিও গেলো, প্রসাদের থালা ও হারালো।তার ওপর একটা লোক কালকে প্রচুর কথা জিগ্যেস করলো,আমার নাম,তোমার নাম,ঠিকানা ,আরো কত কি ,প্রসাদ ও খেলো কিন্তু কি ছোটলোক ভাবো, প্রণামী দিলো না!!!"
বরেন কাকু আস্তে করে উঠে গিয়ে একটা সাদা খাম এনে সবার সামনে ফেলে বললো,
"তোরা ঘুম থেকে ওঠার আগেই সে এসে প্রণামী দিয়েগেছেরে, এক হাজার এক টাকা,তোদের প্রথম পুরস্কার।"




Friday, June 23, 2017

অবচেতন কে চিঠি

অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম,তোমাকে একটা চিঠি লিখি, ইমেইল নয়, টেক্সট নয়,হোয়াটস আপ নয়, বিশুদ্ধ নিখাদ চিঠি।গোদা বাংলায়  ।ছোট্ট করে, অল্প কথায় । কিন্তু কি লিখবো ভাবছিলাম।কতকিছুই যে মাথায় আসে।সবচেয়ে বেশি আসে কিছু না লেখার অজুহাত।মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে, তুমি কি আমার মতোই ক্লান্ত, এবং মাঝে মাঝে কিঞ্চিৎ বিরক্ত! কে জানে! তোমাকে জানার বা বোঝার বিশেষ চেষ্টা কোনোদিন করিনি।কি দরকার ,জীবনে করার মতো আরো কত কি আছে, কেন তোমাকে জেনে সময় নষ্ট করবো? যে ফর্মুলা ওয়ান এ আমি চলেছি,তাতে প্রতিটা পিট স্টপে শুধু এটাই ভাবতে  শেখানো  হয় যে আর কটা ল্যাপ বাকি। বরং মাঝে মাঝে চিন্তা করে দেখেছি যে তোমাকে জানার চেষ্টা করলে বিপদ বেশি।যেমন, তুমি আয়না হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে  বলবে যে আমি কেন জীবনে একটার সঙ্গে আরেকটা ভূমিকায় মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে পাল্টে নিচ্ছিনা ??? আমি বলবো,ধুত্তোর ,নিকুচি করেছে রোল প্লে এর নাটকের , আমি অফিসেও মাঝে মাঝে বাড়ির মতো,বাড়িতেও মাঝে মাঝে অফিসের মতো থাকবো, ভাববো ,হয়তো বা রিএক্ট ও করবো। ব্যালান্স করা জিমন্যাস্ট এর কাজ, আমার নয়। তুমি চুপচাপ শুনবে আর নিঃশব্দে হাসবে।আমি নিজেরই বকবকানিতে নিজে  ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ব, তুমি তো সদা জাগ্রত,ঘুমের বালাই নেই। তুমি অপেক্ষা করবে, আবার আমার জেগে ওঠার,দিন শুরু করার, কিছু ভুল শুরু করার।তুমি এক অদ্ভুত শিক্ষক, যে জ্ঞান দেয় না, সময় কে দিয়ে সময় মতো একটা থাপ্পড় কষিয়ে বুঝিয়ে দাও যে এখনো সময় আছে,শুধরে যা। সব সময় যে তোমার কথা শুনি এমন দাবি কোনোদিন করি না ,তবে চেষ্টা করি।আজ আর লিখবো না, অন্য আরেকদিন ।তোমার কথা আমার ঠিক মনে থাকবে।ও হ্যাঁ, কৈফিয়ত দেওয়ার কিছুই নেই ,তবুও বলি হঠাৎ কেন চিঠি লিখতে বসলাম,
 কারণ বহুদিন পর আবার মনে পড়ে গেল সেই অসাধারণ কথা টা," Talk to yourself at least once a day,otherwise you will miss talking to an excellent person".....ভালো থেকো,নিজের মতো।

Sunday, June 11, 2017

বমমার গিফট

ট্রান্সফারের চাকরির সবচেয়ে বিরক্তিকর জিনিস হল, দুই তিন বছর অন্তর ঘরবাড়ি চেঞ্জ করা।যতই বাজে লাগুক উপায় নেই।ব্যাজার মুখে টুটুল ,তার গল্পের বইয়ের তাক থেকে একটা একটা করে বই প্যাক বক্সে ভরা শুরু করল।বউ সামলাচ্ছে বাচ্চা কে।এরপর টুটুল ধরলে তার বউ বাকিটা গুছোবে। মুভার্স এন্ড পাকার্স রা বলেদিয়েছে যে পচ্ছন্দের জিনিস গুলো আলাদা করে রাখতে।কাল ওরা আসবে। তৃতীয় তাকের বইগুলো গুছোতে  গিয়ে কোনের দিকে একটা ছোট লাল মলাটের বইয়ের দিকে নজর গেল টুটুলের। হাতে তুলে মলাট উল্টোতেই সময় টা যেন এক ঝটকায় একুশ বছর পিছিয়ে গেল।

উনিশশো ছিয়ানব্বই সাল।জানুয়ারি মাস।ঠান্ডা ভালোই।পাড়া গাঁয়ের দিকে ঠান্ডা ভালোই পড়ে।
সকাল থেকেই বাড়িতে হইহই চলছে।আজ টুটুলের পৈতে। থার্ড জেনারেশনের একমাত্র নাতি সে। মামীমারা দূরের পুকুর থেকে কলসী তে করে জল এনেছে।এতে বেশ  কয়েকবার স্নান হবে টুটুলের ।নিচে বাড়ির সামনে একটা ছোট বেদী তৈরি।পুরুত ঠাকুর তার দলবল নিয়ে কাজ শুরু কৱেদিয়েছে।
ক্লাস ফাইভের টুটুল খালি বুঝতে পারছেনা যে এতবার স্নান করতে হবে কেন? তাও শীতকালে !!
ইয়ারকীর ও একটা সীমা থাকে।তার ওপরে ধুতি পরা। আবার নেড়া ও হতে হবে।ইস, বন্ধুরা কি আওয়াজ দেবে!!! এই চিন্তাতেই বিভোর সে।কিন্তু ভীষণ রাগী বাবা কে সে বলতেও পারছে না যে সে নেড়া হতে চায় না।কখনোই চায় না।
এইসব ভাবতে ভাবতেই গায়ে হলুদ হলো, দু তিন দফা স্নান ও হলো।কিন্তু এখনো বমমা আসছে না কেন? টুটুল সেই ভাগ্যবান দের দলে পড়ে যারা নিজেদের ঠাকুমার মা কেও দেখেছে। ঠাকুমা হলো ঠাম্মা আর ঠাকুমার মা হলো বড়মা, সহজে বমমা। আশি বছরের বমমা এখনো সোজা হয়ে হাটে, দারুন হাতের লেখা,একটাও দাঁত নেই,আর হামানদিস্তায় পান থেঁতো করে খায়। টুটুল কেও মাঝে মাঝে দেয়। কাল রাতেই এসেগেছেন তিনি ,সবাইকে বলেদিয়েছেন যে , ওই জিনিসটা টুটুলকে যেন আর কেউ গিফট না দেয়। কিন্তু ওই জিনিসটা কি টুটুল এখনো জানতে পারেনি। কেউ কেউ সাইকেল দেবে বলেছে। একগাদা লোক সকাল থেকে গল্পের বই, পেন , কিলো কিলো রবীন্দ্রনাথ,শরৎচন্দ্র,সুকুমার রায় দিয়েই যাচ্ছে।
এবার ডাক পড়লো নাপিতের কাছথেকে।টুটুলের চোখে প্রায় জল এসেইগেছে। বাবার দিকে একবার তাকালো।কোনো লাভ নেই ।পালানোর উপায় নেই।সদ্য কেনা ক্ষুর সকালের রোদে ঝকমক করে উঠলো আর একটু একটু করে টুটুলের মাথার চুল আর চোখের জল মাটিতে পড়তে থাকলো। গাড়ি প্রায় আদ্ধেক রাস্তা এসেগেছে, হটাৎ ছোটকাকুর গলার আওয়াজ, "একি, এটা কি হচ্ছে!! , বাবু একবার এদিকে তাকা তো ?" অবাক হয়ে টুটুল তাকাতেই খচাৎ, আদ্ধেক নেড়া মাথার অসহায় টুটুলের ছবি তুলে দাঁত বের করে হাসছে ছোটকাকু। দুনিয়াতে একটাও ভালো লোক আর নেই, স্থির সিদ্ধান্ত নিলো টুটুল। এরপর আরো অনেক নাটকের পর ভিক্ষা পর্ব শুরু হলো।খড়ম পরে থালা হাতে ভবতি ভিক্ষাং দেহি শুরু হলো। হাতের আংটি ,নতুন জামা প্যান্টের পিস এইসব শেষে ,টুটুল দেখলো বমমা আসছে এগিয়ে, টুটুলের বুকটা ধুকপুক করে উঠলো, না জানি কি গিফট দেবে বমমা! ফোকলা মুখে একগাল হেসে একটা ছোট্ট বইয়ের প্যাকেট দিয়ে বললো,"মালকড়ি ভেতরে আছে, রাতে দেখিস যখন বাকি বইগুলো দেখবি"।
রাত্রে সব চুকেবুকে যাওয়ার পর নিজের ঘরে একা একা শুয়ে টুটুল একএক করে সব বইগুলো দেখছে।মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হাত বুলিয়ে নিচ্ছে তার নেড়া মাথা। একটা সাদা রঙের নরম টুপি কে যেন দিয়েছে। সেটাই পরে আছে।কিন্তু বালিশে মাথা রাখলেই মনেহয় যেন ফেভিকল দিয়ে সেটে দিয়েছে কেউ।এই সব দুশ্চিন্তা সরিয়ে বমমার দেওয়া প্যাকেট টা খুললো সে, বেরোলো ছোট একটা লাল বই। মলাটে লেখা ,"শ্রীমদভাগবতগীতা" । মলাট ওল্টাতে ই পাওয়া গেল পাঁচশো একটাকা আর বমমা এর হাতে লেখা কয়েকটি লাইন,
"সুস্থ দেহ,শুদ্ধ মতি, ভোগসুখে নাহি রতি,
হও কর্মে ব্রতী,
মানুষ দেবতা হও, শ্রেয়রে জানিতে চাও,
হও মহামতি।"
--এর একটা শব্দও হয়েওঠা হয়নি টুটুলের। অনেক গুলো বছর চলে গেল বমমার পরে, স্মৃতিটুকু আজও অমলিন।

Sunday, May 14, 2017

ফোটোডিয়া


বিমলের চিরকালই শখ ছিল যে একটা ষ্টুডিও বানাবে, ঠিক বাস স্ট্যান্ডের গায়ে। তার এই আধা শহর ফুল মফঃস্বল টাউনে ষ্টুডিও তো অনেক আছে,কিন্তু লেটেষ্ট কেতা ওয়ালা, বাচ্চা ছেলে মেয়ে গুলোকে ফেসবুকের দেওয়ালে ছাপানোর মত আইডিয়া দেবে এরকম বান্দা বেশি নেই।সেই থেকে শুরু হলো "ফোটোডিয়া" ।একশো স্কয়ার ফিটের একটা গ্রাউন্ড ফ্লোর রুম ভাড়া নিয়ে।

হাসিমুখ,সর্বদাই খই ফুটছে এরকম এনার্জি নিয়ে সে কাজ শুরু করে দিলো।ব্যবসা জমে উঠতে দেরী হলো না।মাস আষ্টেক যেতে না যেতেই বিমলের মনে হলো একটা শাগরেদ খুব দরকার। দু-তিন টে অন্নপ্রাশন এর কাজ চারটে বিয়ে বাড়ীর ডাক এনে দিয়েছে।সে ভেবে দেখলো যে ক্যাবলা গোছের লোক হলেই চলে যাবে। ক্যামেরার কাজ সে একা ই ম্যানেজ করে দেবে,দরকার শুধু ব্যাগ-ট্রাইপড-লাইটস-কেবল এই সব বওয়ার জন্য একটা ছোকরা।

স্টুডিওর উল্টো দিকেই কেষ্টদার চায়ের দোকান।মাস দুয়েক হলো,একটা নতুন হেল্পার জুটেছে কেষ্টদার।অসীম ছেলেটা ভীষণ ই চুপচাপ।শান্ত মুখে হালকা হাসি লেগেই আছে।নিঃশব্দে কাজ করে যায়।কিছুতেই বলেনা  ,কোথা থেকে এসেছে,কি তার সমস্যা।কেষ্ট দা একদিন রাতে দোকান বন্ধ করার সময় দেখে যে একটা ছেলে সামনের বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছে। বাস স্ট্যান্ডে কত ভবঘুরে ই তো ওইরকম বসে থাকে।নির্বিকার চিত্তে দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যায় কেষ্ট দা।সকালে এসে দেখে একই জায়গায় ঠায় বসে আছে।কেষ্ট দার অভিজ্ঞ চোখ কিন্তু দয়ার শরীর, রেখে দিলো তাকে কাজে।বিমল চাইতে গাই গুই করেনি।শুধু বলে দিয়েছে,"খেয়াল রাখিস আর পারলে জানার চেষ্টা করিস ওর মতলব !!"

খেয়াল অবশ্যই রেখেছে বিমল। যত্ন করে কাজ শিখিয়েছে অসীম কে। দিন দিন পোক্ত হচ্ছে তার হাত। নিখুঁত থেকে নিখুঁততর হচ্ছে তার কাজ।ব্যবসা ও বাড়ছে ।  সারাদিনের হাসিমুখ থেকে হাসি শুধু মুছে যায় রাত  হলে । বিমলের এক   চিলতে ঘরের  বারান্দা তেই  শুয়ে পড়ে অসীম । চিন্তামগ্ন সে দেখে বোঝাযায় , চিন্তার তল পাওয়া যায় না। নিঃশব্দে কাজ করে চলে সে , দিনের পর দিন , বিনা বাক্যব্যয়ে ।

দেখতে দেখতে ডিসেম্বর ঢুকে গেল ।    বিয়ে  বাড়ির কাজ ,সময়ের সাথে সাথে নতুন নাটকের আবির্ভাব ঘটেছে ।বাঙালীর বিয়েতে সংগীত হচ্ছে,মেহেন্দি হচ্ছে ,বেনারসী জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে লেহেঙ্গা -চোলি কে প্রায় হামেশাই।আর একদম লেটেষ্ট আমদানি হচ্ছে বিভিন্ন পর্যায়ের ফোটোশুট । রকমারি নাম তার, ঝিনচ্যাক কাম ।বিয়ের দু-হপ্তা আগে বর  বৌ হরেক পোজে ফটো তুলবে।গড়ের ময়দানে তুললেও ব্যাকগ্রাউন্ডে  নায়াগ্রা ফলস জুড়তে হবে । লাইক বড়  বালাই ।জীবন ভীষণ রকমই ডিজিট্যাল |এরপর যাচ্ছে ওয়েডিং শুট , পোস্ট ওয়েডিং বিদাই  শুট , ইত্যাদি ।

হানিমুন শুট নিয়েও অনেক নাটক শুনেছে বিমল।তবে তার ব্যক্তিগত কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি ।এইসব নাটকে প্রাথমিক অসুবিধে হলেও ধীরে ধীরে সে বুঝে নিয়েছে যে টিকে থাকতে গেলে উপায় নেই.। অসীম সবই বোঝে কিন্তু কেন জানিনা না বিয়েবাড়ির ছবি তুলতে একদম ই চায় না ।কিন্তু মালিক কে ঘাঁটাতেও  চায় না সে ।

সিজনের  এর শেষ বিয়ে বাড়ি ।বায়নার অ্যাডভান্স এর সাথে বিয়ের কার্ড টা ও দিয়ে গেছে মেয়ের বাড়ির লোক ।রিনা ওয়েডস অর্জুন | এক ঝলকে কার্ডে চোখ বুলিয়ে নিয়েই সরে যায় অসীম ।অভ্যস্ত হাতে  গুছোতে থাকে ব্যাগ । বিমল লক্ষ্য করতে থাকে, একটু যেন দ্রুতই ব্যাগ গুছিয়ে নিলো অসীম।এই কাজের পর দিন পনেরো ছুটি নেবে বিমল।অসীম কেও বলেছে বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে । নিঃশব্দে হেসেছে অসীম । হঠাৎ একটা টুপি হাত বাড়িয়ে চেয়ে নিলো বিমলের কাছ থেকে । অসীমকে আগে কখনো টুপি   পড়তে দেখেনি বিমল ।  বেশ অন্যরকম দেখাচ্ছে তাকে।  প্রায় চেনাই যায় না ।

প্রবল ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কেটেগেলো সারাটা দিন ।এতো লোক,এতো দাবী ,এতো ভিন্ন পোজের মুখ ভ্যাংচানোর ছবি তুলতে হয়েছে যে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় ।অসীমের মুখে চোখে ক্লান্তির কোনো চিহ্ন নেই ।তেল খাওয়া মেশিনের মতো কাজ করে পড়েছে ।অবশেষে খ্যাওয়ার ডাক পড়লো ।খেতে বসতেই যাবে , হঠাৎ ইঙ্গিতে স্টুডিওর চাবিটা চাইলো অসীম ।কে জানে কি ফেলে এসেছে !একটু অবাক হলেও বিমল বিনা প্রশ্নে দিয়ে দিলো চাবি টা ।

কনে বিদায়ের সময় উপস্থিত ।হতচ্ছাড়া অসীমের দেখা নেই ।সবগুলো এঙ্গেল  থেকে দরকারি ছবি একা ম্যানেজ করতে পারছে না বিমল ।হঠাৎ দ্যাখে ,ধীর পায়ে ঢুকছে অসীম ।সামনে আসতেই এক চোট  গাল দিয়ে নিলো বিমল ।অসীমের চোখে  হাসি নেই, রাগ নেই ,আছে খালি এক অদ্ভুত শূন্যতা ।সে সব দেখার সময় ও পেলো না বিমল ।  চাপা গলায় বলল ,"মেয়ে বরের গাড়িতে  উঠছে । ক্লোজ ছবি নে কয়েকটা ঝটপট । চোখে কোল টা  ধরবি ।জল টলোমলো চোখের ছবি মেয়ের বাড়ির লোক বেশি চায় ,বুঝলি?" ঘাড় নেড়ে যন্ত্রের মতো ছবি তুলে  চলে অসীম ।

শেষ ছবিটা তোলার জন্য কনের মুখের খুব কাছাকাছি  ক্যামেরা টা নিয়ে যায় অসীম ।কনে মুখ তুলে এক ঝলক অসীম কে দেখেই চমকে যায়। এমুখ যেন তার চেনা ।কিন্তু মা-বাবার-মাসিদের কান্নায় মুহূর্তের মধ্যেই বাস্তবে  ফিরে  আসে সে । গাড়ির অন্য দিক দিয়ে তার বর ততক্ষণে উঠে পড়েছে ।হঠাৎই খেয়াল পড়ে  রিনার যে গাড়ির যেদিক দিয়ে ক্যামেরা ম্যান তার ছবি তুলছিলো,একটা হলুদ রঙের খাম ঠিক জানালার নিচের খাঁজে গোঁজা রয়েছে । আলতো করে খামটা খুলে দেখে গতরাতের তার বিয়ের মঞ্চে ওঠার ঠিক আগের মুহূর্তের ছবি ।দুহাতে ধরা পান পাতার আড়ালে অপরূপ সুন্দরী তার মুখ, অসাধারণ দক্ষতার সাথে তোলা ।নিজের কোনো ছবি দেখে কোনোদিন এতো খুশি হয়নি রিনা ।

খামের ভিতর আরেক টা ছোট্ট কাগজ ও ছিল ।সেটা খুলে দেখলো যে সেটা আট বছর আগের রিনার  লেখা একটা চিরকুট ।শহর থেকে বহুদূরের একটা গ্রামের ক্লাস টেনের ছাত্রী লিখছে ক্লাস টুয়েলভের বৃত্তি পাওয়া অনাথ ফার্স্টবয়কে ,"আমার একটা ভালো ছবি তুলে দেবে ,অসীম দা ?"


Thursday, May 11, 2017

আমি ই সেই লোক


হালকা করে গলার টাই এর নট টা দেখেনিলাম। স্যুট টা একদম ঠিকঠাক মানিয়েছে। তারপর মধুকে ফোন করলাম।মধু, আমার সেক্রেটারি কাম ম্যানেজার কাম এভরিথিং। আজ কোথায় ডাক আছে সব তার ডায়রি তেই নোট আছে।আমি অত শত মনে রাখতে পারিনা।
ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলাম।নিজের সাবজেক্ট এর বাইরে প্রায় অন্য কোনো বিষয়েই  আগ্রহ বা দক্ষতা ছিল না। কিন্তু আজকাল আমি নিজেই নিজেকে নিয়মিত অবাক করে দিচ্ছি।আন্ডার দা সান প্রায় সব কিছুই আমি জানি দেখছি।গত পরশুই তো বলে এলাম যে পূর্ব আফ্রিকার দ্বীপ গুলোতে ভারতীয় কমার্শিয়াল জাহাজ গুলোর কেন ব্যবসা করতে যাওয়া উচিত নয়। 
ওরা বলল টিআরপি নাকি হেব্বি বেড়েছে।জানেন আমার মধ্যে না  লজ্জা আর ভয় জিনিস টা একেবারে নেই,যাই বলিনা কেন সন্ধেগুলো কাটছে ভালো।পয়সা ও পাচ্ছি ভালোই।ওদের রিসার্চ টিম ই বলে দেয় যে আজ আমি ভিউয়ার দের কি খাওয়াবো। 

আত্মীয় দের বলে দিয়েছি যে আর যাই করো না কেন টিভি দেখে নিজেদের মতামত গঠন করো না ।কিন্তু তারা শুনলে তো।যদি এরা একবার জানত!! কি ঘটছে আর কে ঘটাচ্ছে পেছনে। ইংরাজি চ্যানেল গুলোতে শুনেছি বেশি মালপত্র দেয়।ভাবছি এই বয়েসে একবার ট্রাই মারব কিনা। ও হ্যাঁ, বলে ভুলে গেছি যে আমি ই সেই সবজান্তা বিশেষজ্ঞ যাকে আপনারা রোজ রাতে টিভিতে দেখেন,এনজয় করেন,পরে আলোচনা করেন,মজা পান।আমিও মজা পাই ,যখন শো শেষে চেক টা পকেটে ভরে ঠান্ডা গাড়িতে বাড়ী যাই, মজা পাই আপনাদের আগ্রহ দেখে,প্রস্তুত হই পরের দিনের জন্য। আরেকটা কথা, আমি কিন্তু একা নই।

Tuesday, May 9, 2017

এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ ...

--বলছিলাম  স্যার , ইন্টেলেকচুয়াল  প্রপার্টি রাইটস  আসার বহুযুগ আগেই আপনি কেস টা ঠিক বুঝে ফেলছিলেন কেমন করে বলুন তো?
~ মানে ? আপনার কথা টা পরিষ্কার করবেন একটু ?
--মানেটা এই যে এই পোড়ার দেশে আপনার সময়কার কেউ বোঝেনি যে তারা বা তাদের কাজ যদি বিখ্যাত হয়ে যায়,তাহলে অদূর ভবিষ্যতেই তাদের কাজ নিয়ে ঝাঁকিয়ে মশলামুড়ি বানানো হতে পারে।আপনি বহু বছর আগেই সেরকম সুযোগ না দিয়ে স্পষ্ট ভাবে বিশ্বভারতীকে  দিয়ে গেলেন কপিরাইট রক্ষার দায়িত্ব ।
~ওহ ! তা সেরকম দেখতে গেলে তো অনেক কাজ ই আমি শুরু করেছিলাম,কই ,আপনার নজর সেদিক গুলো এড়িয়ে যাচ্ছে কেন?
--আপনি স্যার,আপনি আমাকে  আপনি বলছেন ! এই ইন্টারভিউ আমার জীবন বদলে দেবে ।আমি আপনার প্রনাতির নাতির থেকেও ছোট ।
~আপনি-তুমি-তুই ,আবার রেগে গেলে এর বিপরীত পর্যায়ে সম্বোধন ! এত ব্যাকরণগত পরিবর্তন কথা বলতে বলতে করতে অসুবিধা হতে পারে,তাই সহজ পন্থাটা বেছে নিলাম।
--জানেন স্যার ,আমার কলিগরা কেউ  বিশ্বাসই করবে না যে আপনি এত ফ্রি-ফ্র্যাঙ্ক ইন্টারভিউ দিতে পারেন।তারা মাঝে মাঝেই এমন সব কথা বলে যে মাথা গারম হয়ে যায়।কিন্তু স্যার মুখের মত উত্তর আসেনা বলে চেপে যাই।পড়ার টেবিলের পেছনে দেওয়ালে মাদুর কাঠিতে আপনি আছেন স্যার , ভাট বকলে মটকা গরম হয়ে যায়। ওরা বলে ,আপনি নাকি সৌখিন দুঃখবিলাসী ,খালি বড়োলোকদের জন্য লিখতেন,জন্মসুত্রে যা আপনি নিজেও ছিলেন ।
~আর কি বলেন আপনার সহকর্মীরা ?
--বলে খাওয়া পরার চিন্তা ছিল না তো, আপনার প্রচুর টাইম ছিল ।
~সেটা কি আমার ক্রাইম ছিল ?
--এটা কিন্তু ভাল রাইম ছিল।
~"ডেঁপো" শব্দ টা আমার লেখনী তে লেখা হয়নি কখনো।এখন আফশোস হচ্ছে।
--খেপছেন কেন স্যার ,হিসেব করে দেখেছি কিলোপ্রতি আপনার লেখার দর লিস্টে প্রায় নিচের দিকে থাকছে, সে যে জাতের লেখাই আপনি লিখেন না কেন ! আজকাল অবশ্য অনেক জাতের লেখা বিক্রি হচ্ছে।  বলুন না,আপনি যে সব শব্দ অভিধান কে দান করে গেছিলেন,যেমন বেতার, তেজস্ক্রিয়তা ইত্যাদি,আমার মনে একটা শব্দ আছে, সে একজনের জন্য প্রযোজ্য,কিন্তু আপনি এটার একটা বাংলা প্রতিশব্দ দেবেন?
~কি শব্দ?
--মেগালম্যানিয়াক ।
~হুম।ভেবে জানাব ।আচ্ছা একটা কথা আপনি বলুন তো?বাংলায় কথা বলতে বলতে এত ইংরাজি বলেন কেন? কোন ব্রিটিশ কে দেখেছেন যে ইংরাজি বলতে বলতে স্প্যানিশ বলছে ?
--ইটস দ্য ইন থিং স্যার।মাঝে মাঝে ইংরাজি  ঝাড়লে কুল শোনায়।নো চাপস।
~নো চাপস! এটা কি ইংরাজি নতুন শব্দ    ?
--আপনি বুঝবেন না স্যার।আমরা বাংলা তে আরবান ডিকশনারি বানাব ।
~আর কি কি বানাবেন ?
--বাংলা বাচাও স্মৃতি স্তম্ভ । এর দুটো মানে আছে ।
--উদবোধনের দিন  বা শিলান্যাস এর  জন্য আমাকে    ডাকবেন না তো?    
--না স্যার । উদবোধনে বা শিলান্যাসে গিনেস রেকর্ড হোল্ডার আমাদের এখানে আছেন । অন্য কাউকে কোনও চান্স ই দেব না।
~আপনি কি উত্তেজিত ? অবশ্য সেটাই বয়েসের স্বভাব।
--নো স্যার, আমি উদ্দীপিত ।খালি সংরক্ষিত মেধার অভাব ।
~হতাশা উদ্গীরণ শেষ হলে আমি যাই     ?
--না স্যার, ইন্টারভিউ আপনার।আর আমি বকবক করে গেলাম।আসলে স্যার আপনি আমাদের অনেক আগেই বুঝেগেছিলেন যে ,"আমরা আড়ম্বর করি ,শেষ করি না !" এটুকু বুঝি যে আপনার চিন্তা ভাবনা গুলো বড্ড বেশী প্রগ্রেসিভ ছিল ।
~আমাকে উদযাপন না করে আমার কাজ আর চিন্তাধারাকে বেশী করে যাপন করলে বোধহয় ভাল করতেন। দীর্ঘ জীবন অনেক কিছু শিখিয়েছে।লেখায়   রেখে গেছি ।পারলে নেড়েচেড়ে দেখবেন ।
--সে তো বুঝলাম স্যার, ঐ যে বললাম স্যার সময় কে বোঝার মত সময় নেই আমার ।এই বছর প্রমোশন ডিউ কিনা।কিন্তু স্যার ,এই ইন্টারভিউ আমার জীবন বদলে দেবে স্যার।প্রমিস করছি প্রমোশন পেলেই ট্রাফিক সিগ্ন্যালে  আপনার গান বাজানো বন্ধের দাবীতে তিন লাইন লিখব ।
~আর কিছু করবেন ?
-----------------------------------------------------------------------------------
"এ বার কালী তোমায় খাবো",বিদ্ঘুটে এস এম এসের শব্দে ধড়ফড় করে ঘুম ভেঙ্গে   উঠে বসল, সাংবাদিক ক্যাবলাকান্ত ।বসের জন্য ডেডিকেটেড টিউন । মোবাইল আনলক করতেই মেসেজ ঢুকল,"সাড়ে আটটার মধ্যে পাঞ্জাবি গলিয়ে শান্তিনিকেতনী ঝুলিয়ে সদনে এস ছন্দ্রবদন, দেরী হলে কপালে নান্দনিক ক্যালানি জুটবে.........।"                                                                                                                                                                                                                                                       









Monday, May 1, 2017

সেই আড্ডার রেশ ধরে ...



ন্যাপলা হঠাত ডান হাতের তর্জনী ওপরের দিকে করে বলে উঠল ," স্যার ,অনেকেই অনেক কিছু বলছেন,আমিও কিছু
প্রশ্ন করব স্যার ? মানে খুব কিউরিয়সিটি হচ্ছে ।
--হু ।
--বলছিলাম কি ,ফেলুদা বিয়ে করলেন না কেন ?
চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে বিষম খেলেন লালমোহন বাবু,মগনলালের সুগন্ধী পানমশালা,হাতের চামচ থেকে মুখের বদলে নাকের দরজায় আঘাত করে ছড়িয়ে পড়ল, কিন্তু হাঁ বন্ধ হল না ! ছোকরা বলে কি !
--"আর কিছু ?",গম্ভীর কন্ঠে স্নিগ্ধ প্রশয়ের ছোঁয়া ...
--না মানে ,জানার তো অনেক কিছুই ছিল।যদি অভয় দেন তো বলি,খুড়ো যে ভাবে আমার কনুই তে রামচিমটি দিচ্ছেন,বেশীক্ষণ বাঁচার গ্যারান্টি নেই ।
--বলো,বলো ,আজ তো তোমাদের কথা শুনব বলেই এসেছি
-- আচ্ছা স্যার , এ বাংলায়  রিসেন্টলি একটাও পপুলার বেস্টসেলার রাইটার এল না কেন লালমোহন বাবুর পরে? দেশ জুড়ে জনতা অচেতন, নিরামিষ পড়ে ফাটিয়ে দিল, অবশ্য স্যার আপনার কিছুই অজানা নয়।আজকাল শুনছি,লেখকেরা নাকি কোন রঙ এর কালিতে লিখবেন সেটা নিয়েও তিনমাস ভাবে, কি লিখবে সেটা ভাবার আগে।
--মুচকি হেসে তিনি বললেন ,"বেশ ,বাকিদের কথাও একটু শুনি, তুমি কি একটা নন-কমারশিয়াল ব্রেক নেবে ন্যাপলা?"
সিধুজ্যাঠা বলে উঠলেন এবার,"আমার বক্তব্য একটু অন্য দিকে। আপনি না হয় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য পাননি।কিন্তু এখন তো অবস্থা সেরকম নয়, তাহলে আজ ও কেন শঙ্কুর কান্ড কারখানা নিয়ে একটাও সিনেমা বেরোল না? বাংলায় যদি নাও হয় , অন্য ভাষায় , ইংরাজিতে হতেই পারত । এত রিচ কন্টেন্ট ,এত দারুন রোমহর্ষক টান টান গল্প !! এ থেকে যদি সিনেমাপ্রেমীরা বঞ্চিত হয় তা তো হতাশার ,তাই না ?"   এবার নকুড় বাবুর পালা ।হাত কচলে বলে উঠলেন ,""স্যার, তিলুবাবুর লাইব্রেরী থেকে মাঝে মাঝে ধার নিয়ে আপনার প্রায় সব গল্পই আমার পড়া। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব স্যার ? খগম না রতন বাবু না বঙ্কুবাবু না আপনার অনন্য অনুবাদ গুলো !! এই যে ধারা টা আপনি তৈরি করে দিয়ে গেলেন,সেটা আর কেউ ধরতেই পারল না।অবশ্য সেই জন্যই আপনি আপনার জায়গায় ।কিন্তু লেখা নিয়ে চিন্তা নিয়ে ভাবনা  নিয়ে এক্সপেরিমেন্টের খুব অভাব দেখি । আবেগে ভেসে একটু বেশী বলে ফেললাম।অপরাধ নেবেন না স্যার ।মগনলাল আরামসে আড্ডা শুনছিলেন , হঠাত বলে উঠলেন,"আমার যেটা মনে হয় স্যার, গাড়ি কেন আর এগোল না, তার পিছনে একটাই কারন, দুনিয়াকা সবসে বড়া রোগ, কি কেয়া কহেঙ্গে লোগ , কি আঙ্কেল ঠিক বলেছি?"
ডান পা টা নামিয়ে  ,তার উপর বাঁ পা টা আলতো করে রেখে ধীরে ধীরে বলে উঠলেন স্রষ্টা ,"আপনাদের প্রায় প্রত্যেকের কথাই যুক্তিপূর্ণ   ,সে বিষয়ে সন্দেহ নেই  । কিন্তু আমার পরিস্থিতি অন্য ছিল ।অনেক সিদ্ধান্ত , অনেক যতি চিহ্ন আমায় অনেক ক্ষেত্রে নিতে হয়েছে যার পেছনে বহু অকথিত কাহিনী আছে যেগুলো আজ আমি জানানোর কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা । আর আজকাল যা ঘটছে তার উপর তো আমার কোনও নিয়ন্ত্রনও নেই ,তাই না সিধুজ্যাঠা ? চিন্তনের ফারাক এসেগেছে, সময় ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে ।বদলেছে অনেক সমীকরণ।নিয়মিত খুঁটিয়ে কাগজ পড়া আমার দৈনিক অভ্যাসের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল ।আজ তা আমায় কিঞ্চিত ব্যাথা দেয় ।বোধহয় সময় এসেছে বোঝার যে আমরা কি খাচ্ছি আর আমাদের কি খাওয়ানো হচ্ছে তার পার্থক্য । তোমরা প্রত্যেকে আমার ভীষণ প্রিয় , হয়ত খুব খুঁটিয়ে দেখলে তোমাদের অনেকেই হচ্ছ ভিন্ন ভিন্ন সময়ের,পরিস্থিতির ভিন্ন ভিন্ন আমি। তোমরা নিজেরাই বুঝে নাও, কেন কখন আমি কোন সিদ্ধান্ত নিয়েছি বা নিতে বাধ্য হয়েছি ।কারন তোমরাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছ ।  আজ ও ।" নিজেকে চেয়ার একটু এলিয়ে দিয়ে অল্প  হাসেন স্রষ্টা । সৃষ্টি দেরও চোখে জল ।এবারের মত বিদায় আসন্ন । ্সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে একে একে হাত মেলাতে গেলেন আর মিলিয়ে গেলেন তাঁর সাথে। সবাই ,শুধু ফেলুদা বাদে ।

মুখোমুখি দুজনে।  চোখে চোখ রেখে , সামনে দাবার বোর্ড টা পাতা । বোড়ে একঘর এগিয়ে বলে উঠলেন তিনি ,"সব ই তো শুনলে , তুমি কিছু আমাকে বলবে না ?" সেই চিরাচরিত একপেশে হাসিটা হেসে ফেলুদা বলল,"নিজেকে নিজেই কিছু জানাতে হলে সেতো নীরবেই জানানো যায় , তাই না ?..."  আপনার চাল ...





Saturday, April 22, 2017

তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ ...



গলা একটু  খাঁকরিয়ে ধীরে ধীরে রজনী সেন রোডের বাড়ীটার বৈঠকখানায় ঢুকলেন নকুড়বাবু , পরিচিত কুন্ঠাবোধ  সদা বিরাজমান। ঢুকেই বিস্ময়াবিষ্ট চোখে প্রশ্ন,"সে কি , তিলু বাবু এখনও এসে পৌঁছাননি !!" পঁচিশ বছরে পাংচুয়ালিটি তে কি ধার কমে গেল ??   ... সেই চেনা গলায় বৈঠকখানার আরেক কোণ থেকে বলে উঠলেন মগনলাল মেঘরাজ,"আরে আইয়ে আইয়ে , বৈঁঠিয়ে তো সহি ।  ছিনাথ , যাও থোড়া  নাস্তা পানি কা বন্দবস্ত তো করো । মিস্টার মিত্তির তো মেহমাননওয়াজির জিম্মা আমাকেই দিয়ে বললেন এক ঘোন্টার মধ্যে আসছি। বুঢঢা হলে দেখছি বহুত জ্বালা , ইদিকে আঙ্কেল এখনও আসেনি।"

তপসে টা  একই ভাবে খালি অবজারভ করে যাচ্ছে।  ভাবছে এতগুলো বছরেও ক্যারেক্টার গুলোর কোনও পরিবর্তন 
হলনা ।লোকটার এলেম ছিল সত্যি।  ঐ তো সবুজ আম্বাসাডর টা রজনীসেন রোডে ঢুকছে ।মার্কেট থেকে উঠে গেলেও
কালমোহন বেঙ্গলি আজও ধরে রেখেছেন ।  যদিও বিকট হর্ন টা নেই। তার বদলে গাড়ী ব্যাক করতে গেলে গুগাবাবার সিগনেচার টিউন টা, ঐ যে ভদ্রলোক বানিয়েছিলেন , সেটাই বাজে । কালজয়ী প্রতিভা , সব কালেই আভা ছড়ায় । লালমোহন বাবু তো ঘরে ঢুকেই মগনলালের হাত থেকে ডালমুটের প্লেট টা ছিনিয়ে নিলেন,আর আড়চোখে তোপসে কে দেখে বললেন,"এটা   আমার ..."  

ন্যাপলা এখন অনেক বড় হয়েগেছে ।তবু খুড়োর সামনে লজ্জা পায় । এই বয়সেও খুড়ো সটান গটগট করে হেটে চলে।তবে আজ খুড়োর মুড ভাল । এক্সপোর্ট কোয়ালিটির বিড়ি ধরিয়ে বৈঠকখানায় এন্ট্রি নিতে নিতে বলল," চল, আজ তোকে একটা লোকের সাথে আলাপ করিয়ে দেব , চমকে যাবি " ।

"তোমার নিউটন কে আমার ভারি পছন্দ ,বুঝলে শঙ্কু , অনেক গুলো দিন কেটে গেল । আজকাল আর পেপার কাটিং দেখতে হয়না ।মোবাইল ই কাফি । ফেলুটাও চট করে দেখা করে না। দরকার হলেই ফেসটাইম করে নেয় ।বলল তোমাকে রিসিভ করে ওর বাড়ীতে নিয়ে আসতে । কিছু বলেছে তোমায় , কি ব্যাপার ? "।চশমা মুছতে মুছতে প্রফেসর জবাব দিলেন,"কিচ্ছু ভাববেন না সিধুজ্যাঠা, আজ একজনের সাথে আলাপ হবে । আনন্দ পাবেন ।"

তোপসেও হাত লাগিয়েছে ।অন্য দিকে ফেলুদা ।ধীরে ধীরে চকলেট ব্রাউন রঙ এর সেই বিখ্যাত চেয়ার টা তাদের 
 বৈঠকখানার ঠিক মাঝখানে উপস্থিত করল ফেলুদা। সবাই অবাক ।একি , খালি চেয়ার মাঝখানে রেখে প্লানচেট হবে নাকি ? উপস্থিত সবার দিকে একবার দেখে নিয়ে সেই একপেশে হাসিটা হেসে ফেলু দা বলল ,"আজকে গল্পটা জমবে, বুঝলি তপসে ,তিনি আসছেন ।"

ধীর পায়ে দীর্ঘদেহী এক রাশভারী গর্বিত বাঙালী , পাইপ টা  ঠোটের বাঁদিকে  ঝুলিয়ে ,ডান পা টা বাঁ পায়ের উপর 
রেখে চেয়ারটি দখল করলেন ।  বৈঠকখানায় তখন একটা   পিন  পরলেও যেন শব্দ হবে  । স্বভাব গাম্ভীর্য একটু 
সরিয়ে মুচকি হেসে স্রষ্টা বলে উঠলেন ব্যারিটোনে ," তাহলে , আড্ডা শুরু হোক " ।