বিমলের চিরকালই শখ ছিল যে একটা ষ্টুডিও বানাবে, ঠিক বাস স্ট্যান্ডের গায়ে। তার এই আধা শহর ফুল মফঃস্বল টাউনে ষ্টুডিও তো অনেক আছে,কিন্তু লেটেষ্ট কেতা ওয়ালা, বাচ্চা ছেলে মেয়ে গুলোকে ফেসবুকের দেওয়ালে ছাপানোর মত আইডিয়া দেবে এরকম বান্দা বেশি নেই।সেই থেকে শুরু হলো "ফোটোডিয়া" ।একশো স্কয়ার ফিটের একটা গ্রাউন্ড ফ্লোর রুম ভাড়া নিয়ে।
হাসিমুখ,সর্বদাই খই ফুটছে এরকম এনার্জি নিয়ে সে কাজ শুরু করে দিলো।ব্যবসা জমে উঠতে দেরী হলো না।মাস আষ্টেক যেতে না যেতেই বিমলের মনে হলো একটা শাগরেদ খুব দরকার। দু-তিন টে অন্নপ্রাশন এর কাজ চারটে বিয়ে বাড়ীর ডাক এনে দিয়েছে।সে ভেবে দেখলো যে ক্যাবলা গোছের লোক হলেই চলে যাবে। ক্যামেরার কাজ সে একা ই ম্যানেজ করে দেবে,দরকার শুধু ব্যাগ-ট্রাইপড-লাইটস-কেবল এই সব বওয়ার জন্য একটা ছোকরা। স্টুডিওর উল্টো দিকেই কেষ্টদার চায়ের দোকান।মাস দুয়েক হলো,একটা নতুন হেল্পার জুটেছে কেষ্টদার।অসীম ছেলেটা ভীষণ ই চুপচাপ।শান্ত মুখে হালকা হাসি লেগেই আছে।নিঃশব্দে কাজ করে যায়।কিছুতেই বলেনা ,কোথা থেকে এসেছে,কি তার সমস্যা।কেষ্ট দা একদিন রাতে দোকান বন্ধ করার সময় দেখে যে একটা ছেলে সামনের বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছে। বাস স্ট্যান্ডে কত ভবঘুরে ই তো ওইরকম বসে থাকে।নির্বিকার চিত্তে দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যায় কেষ্ট দা।সকালে এসে দেখে একই জায়গায় ঠায় বসে আছে।কেষ্ট দার অভিজ্ঞ চোখ কিন্তু দয়ার শরীর, রেখে দিলো তাকে কাজে।বিমল চাইতে গাই গুই করেনি।শুধু বলে দিয়েছে,"খেয়াল রাখিস আর পারলে জানার চেষ্টা করিস ওর মতলব !!"
খেয়াল অবশ্যই রেখেছে বিমল। যত্ন করে কাজ শিখিয়েছে অসীম কে। দিন দিন পোক্ত হচ্ছে তার হাত। নিখুঁত থেকে নিখুঁততর হচ্ছে তার কাজ।ব্যবসা ও বাড়ছে । সারাদিনের হাসিমুখ থেকে হাসি শুধু মুছে যায় রাত হলে । বিমলের এক চিলতে ঘরের বারান্দা তেই শুয়ে পড়ে অসীম । চিন্তামগ্ন সে দেখে বোঝাযায় , চিন্তার তল পাওয়া যায় না। নিঃশব্দে কাজ করে চলে সে , দিনের পর দিন , বিনা বাক্যব্যয়ে ।
দেখতে দেখতে ডিসেম্বর ঢুকে গেল । বিয়ে বাড়ির কাজ ,সময়ের সাথে সাথে নতুন নাটকের আবির্ভাব ঘটেছে ।বাঙালীর বিয়েতে সংগীত হচ্ছে,মেহেন্দি হচ্ছে ,বেনারসী জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে লেহেঙ্গা -চোলি কে প্রায় হামেশাই।আর একদম লেটেষ্ট আমদানি হচ্ছে বিভিন্ন পর্যায়ের ফোটোশুট । রকমারি নাম তার, ঝিনচ্যাক কাম ।বিয়ের দু-হপ্তা আগে বর বৌ হরেক পোজে ফটো তুলবে।গড়ের ময়দানে তুললেও ব্যাকগ্রাউন্ডে নায়াগ্রা ফলস জুড়তে হবে । লাইক বড় বালাই ।জীবন ভীষণ রকমই ডিজিট্যাল |এরপর যাচ্ছে ওয়েডিং শুট , পোস্ট ওয়েডিং বিদাই শুট , ইত্যাদি ।
হানিমুন শুট নিয়েও অনেক নাটক শুনেছে বিমল।তবে তার ব্যক্তিগত কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি ।এইসব নাটকে প্রাথমিক অসুবিধে হলেও ধীরে ধীরে সে বুঝে নিয়েছে যে টিকে থাকতে গেলে উপায় নেই.। অসীম সবই বোঝে কিন্তু কেন জানিনা না বিয়েবাড়ির ছবি তুলতে একদম ই চায় না ।কিন্তু মালিক কে ঘাঁটাতেও চায় না সে ।
সিজনের এর শেষ বিয়ে বাড়ি ।বায়নার অ্যাডভান্স এর সাথে বিয়ের কার্ড টা ও দিয়ে গেছে মেয়ের বাড়ির লোক ।রিনা ওয়েডস অর্জুন | এক ঝলকে কার্ডে চোখ বুলিয়ে নিয়েই সরে যায় অসীম ।অভ্যস্ত হাতে গুছোতে থাকে ব্যাগ । বিমল লক্ষ্য করতে থাকে, একটু যেন দ্রুতই ব্যাগ গুছিয়ে নিলো অসীম।এই কাজের পর দিন পনেরো ছুটি নেবে বিমল।অসীম কেও বলেছে বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে । নিঃশব্দে হেসেছে অসীম । হঠাৎ একটা টুপি হাত বাড়িয়ে চেয়ে নিলো বিমলের কাছ থেকে । অসীমকে আগে কখনো টুপি পড়তে দেখেনি বিমল । বেশ অন্যরকম দেখাচ্ছে তাকে। প্রায় চেনাই যায় না ।
প্রবল ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কেটেগেলো সারাটা দিন ।এতো লোক,এতো দাবী ,এতো ভিন্ন পোজের মুখ ভ্যাংচানোর ছবি তুলতে হয়েছে যে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় ।অসীমের মুখে চোখে ক্লান্তির কোনো চিহ্ন নেই ।তেল খাওয়া মেশিনের মতো কাজ করে পড়েছে ।অবশেষে খ্যাওয়ার ডাক পড়লো ।খেতে বসতেই যাবে , হঠাৎ ইঙ্গিতে স্টুডিওর চাবিটা চাইলো অসীম ।কে জানে কি ফেলে এসেছে !একটু অবাক হলেও বিমল বিনা প্রশ্নে দিয়ে দিলো চাবি টা ।
কনে বিদায়ের সময় উপস্থিত ।হতচ্ছাড়া অসীমের দেখা নেই ।সবগুলো এঙ্গেল থেকে দরকারি ছবি একা ম্যানেজ করতে পারছে না বিমল ।হঠাৎ দ্যাখে ,ধীর পায়ে ঢুকছে অসীম ।সামনে আসতেই এক চোট গাল দিয়ে নিলো বিমল ।অসীমের চোখে হাসি নেই, রাগ নেই ,আছে খালি এক অদ্ভুত শূন্যতা ।সে সব দেখার সময় ও পেলো না বিমল । চাপা গলায় বলল ,"মেয়ে বরের গাড়িতে উঠছে । ক্লোজ ছবি নে কয়েকটা ঝটপট । চোখে কোল টা ধরবি ।জল টলোমলো চোখের ছবি মেয়ের বাড়ির লোক বেশি চায় ,বুঝলি?" ঘাড় নেড়ে যন্ত্রের মতো ছবি তুলে চলে অসীম ।
শেষ ছবিটা তোলার জন্য কনের মুখের খুব কাছাকাছি ক্যামেরা টা নিয়ে যায় অসীম ।কনে মুখ তুলে এক ঝলক অসীম কে দেখেই চমকে যায়। এমুখ যেন তার চেনা ।কিন্তু মা-বাবার-মাসিদের কান্নায় মুহূর্তের মধ্যেই বাস্তবে ফিরে আসে সে । গাড়ির অন্য দিক দিয়ে তার বর ততক্ষণে উঠে পড়েছে ।হঠাৎই খেয়াল পড়ে রিনার যে গাড়ির যেদিক দিয়ে ক্যামেরা ম্যান তার ছবি তুলছিলো,একটা হলুদ রঙের খাম ঠিক জানালার নিচের খাঁজে গোঁজা রয়েছে । আলতো করে খামটা খুলে দেখে গতরাতের তার বিয়ের মঞ্চে ওঠার ঠিক আগের মুহূর্তের ছবি ।দুহাতে ধরা পান পাতার আড়ালে অপরূপ সুন্দরী তার মুখ, অসাধারণ দক্ষতার সাথে তোলা ।নিজের কোনো ছবি দেখে কোনোদিন এতো খুশি হয়নি রিনা ।
খামের ভিতর আরেক টা ছোট্ট কাগজ ও ছিল ।সেটা খুলে দেখলো যে সেটা আট বছর আগের রিনার লেখা একটা চিরকুট ।শহর থেকে বহুদূরের একটা গ্রামের ক্লাস টেনের ছাত্রী লিখছে ক্লাস টুয়েলভের বৃত্তি পাওয়া অনাথ ফার্স্টবয়কে ,"আমার একটা ভালো ছবি তুলে দেবে ,অসীম দা ?"
| ||
Form is temporary,permanent is class...Bottles are temporary,permanent is glass..
Sunday, May 14, 2017
ফোটোডিয়া
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment