Sunday, June 25, 2017

প্রসাদের থালা

আমি বল্টে, বয়স চোদ্দ, রোগাটে গড়ন, গায়ের রং কালো, আর বয়সের তুলনায় একটু লম্বা আর একটু পাকা, বরেন কাকু বলে। রঘুনাথপুরের স্টেশনের ঠিক পেছনে বুড়ো বট তলার পূর্ব পাশেই বরেন  কাকুর দো তলা মাটির বাড়ি। জন্ম থেকে সেখানেই আছি। বরেন কাকুর তিনকুলে কেউ এখন আর নেই, আমারও  কেউ ছিল কিনা জানি  না। বছর কুড়ি আগেই একটা এক্সিডেন্ট এ বরেন কাকুর বউ,বাচ্চা,বাবা আর মা মারা যান। বরাতজোরে টিকে গেছিলো বরেন কাকু।আর বিয়ে করেনি।বাড়িটাকে একটা অনাথ আশ্রম বানিয়ে দিয়েছে।আমি ই এক নম্বর এই বাড়িতে।আরো আটজন আছে। বরেন কাকু আমাকে স্টেশনের ধারে রাখা একটা  ভাঙা ওয়াগোনের ভেতরে পেয়েছিল গামছা জড়ানো অবস্থায়।চারপাশে অনেক জং ধরা নাট বল্টু পড়ে ছিল।সেই থেকে  আমি বল্টে ।
এক নম্বর তাই একটু বেশি ভালোবাসে।কি যেন বলল,হ্যাঁ, আমাকে দত্তক নিয়েছে, নাম দিয়েছে অজয়, আমার আধার কার্ড ও আছে। ক্লাস এইটে পড়ি আমি।পরশুদিন ক্লাসে ব্যাটারী নিয়ে এসেছিলেন ভৌতবিজ্ঞানের স্যার। বেশ মজার জিনিস শেখালেন।কাল স্কুল ছুটি, কাল তো রথ।এই রথের দিনগুলো বেশ মজা হয়, বরেন কাকু রথ এনে দেয় একটা ছোট্ট, আমরা সবাই মিলে সেটাকে সাজাই। রথ সাজানো কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়।রঙ্গিন কাগজ,সেলোটেপ, আঠা,কাঁচি আরো কত কি লাগে।
আমাদের পাড়ায় প্রতি বছর রথের মেলা হয়, রথ কম্পিটিশান হয়, একবার ও ফার্স্ট হতে পারিনি।এবারে ও চেষ্টা করতে হবে।শোলা কেটে নকশা ভালোই পারি, কিন্তু আলো নিয়েই মুশকিল,মোমবাতি ই ভরসা। কিন্তু এবারে ঠিক করেছি ব্যাটারী  আলো করবো।এভারেডি ব্যাটারী এনেছি বড় গুলো,তিন টে।একটার পর একটা পরপর লাগিয়ে ভালোকরে খবরের কাগজে এগ রোলের মতো পাকিয়ে নিয়েছি।এবার টুনি কিনে হোল্ডারে জুড়ে দিলেই হলো।লাল তার একদিকে আর অন্য দিকে কালো তার , আর পুরোটাকে আটকে রাখার জন্য গার্ডার। ব্যাস ,হয়েগেলো আলো।এইবারে প্রসাদ টাও ভালো করে করতে হবে, চানা, বাতাসা, কলা,শসা তো থাকবেই,ভাবছি নকুলদানাও দেবো।অনেক কষ্টে বরেন কাকুকে রাজি করিয়েছি।আসলে ধান্দা অন্য।আমি দেখেছি যে রথের মেলায় লোকে চারাগাছ ছাড়া আর কিছু কেনে না,ভালো রথের দিকে তাকিয়ে প্রশংসা করে বটে কিন্তু প্রণামী দেয় না, কিন্তু প্রসাদ পেলে কিছু না কিছু দেবেই। সেই টাকা জমিয়ে পরের দিন ফিস্ট করব।সেটাই মজা। সব্বাইকে আমার প্ল্যান বলে দিয়েছি।সবাই রাজি। বরেন কাকু কে বলিনি,খুব মারবে তাহলে।
টাকা ভালোই উঠছে, জগন্নাথ,বলরাম,সুভদ্রার কৃপায়।এমন সময় হঠাৎ ভীষণ ঝড় উঠলো,তারসাথে বৃষ্টি। সব যেন লণ্ডভণ্ড করেদেবে।সবাই পালাতে ব্যস্ত। একটাই মাত্র লোক তখন আমাদের রথের সামনে দাঁড়িয়ে,গম্ভীর মুখে আমাদের নাম কি,কোথায় থাকি জিগ্যেস করছে আর টকা টক প্রসাদ খেয়ে যাচ্ছে,প্রণামী দেওয়ার নাম ই নেই।আমরা তখন পালাতে পারলে বাঁচি।দুহাতে রথ টা জড়িয়ে দৌড় দিলাম আমি ।বাকিদের কেউ সামলাচ্ছে প্রণামী এর বাটি, কেউ প্রসাদের থালা। প্রচন্ড বৃষ্টি আর কড়কড় করে বাজ পড়ছে। সবাই আলাদা হয়েগেছি। রাত অনেক,ভয় ও করছে।অনেক দেরিতে যখন বাড়ি পৌঁছলাম,দেখি বরেন কাকু হ্যারিকেন হাতে বাইরের ঘরে পায়চারি করছে।আমাকে দেখে ,কান টা খুব জোরে পাকিয়ে দিয়ে বললো,"পালের গোদা হয়েছ? এক চড়ে পিঠ ফাটিয়ে দেব তোর, এতগুলো বাচ্চা কে নিয়েগেছিস,কোনো আক্কেল আছে?" কোনোমতে চোখের জল সামলে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লাম।প্রসাদের থালা, প্রণামী এর বাটি,সব হারিয়ে গেছে,রথ টা  এক কোণে রেখে প্রনাম করে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে রোদ উঠেছে,আমাদের মন ও আকাশের মতো ঝকঝকে হয়ে উঠেছে।পান্তা,আলুমাখা আর কাঁচালঙ্কা খেতে খেতে বললাম,"জানো বরেন কাকু,আমাদের ফিস্ট ও গেলো, প্রণামী এর বাটিও গেলো, প্রসাদের থালা ও হারালো।তার ওপর একটা লোক কালকে প্রচুর কথা জিগ্যেস করলো,আমার নাম,তোমার নাম,ঠিকানা ,আরো কত কি ,প্রসাদ ও খেলো কিন্তু কি ছোটলোক ভাবো, প্রণামী দিলো না!!!"
বরেন কাকু আস্তে করে উঠে গিয়ে একটা সাদা খাম এনে সবার সামনে ফেলে বললো,
"তোরা ঘুম থেকে ওঠার আগেই সে এসে প্রণামী দিয়েগেছেরে, এক হাজার এক টাকা,তোদের প্রথম পুরস্কার।"




Friday, June 23, 2017

অবচেতন কে চিঠি

অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম,তোমাকে একটা চিঠি লিখি, ইমেইল নয়, টেক্সট নয়,হোয়াটস আপ নয়, বিশুদ্ধ নিখাদ চিঠি।গোদা বাংলায়  ।ছোট্ট করে, অল্প কথায় । কিন্তু কি লিখবো ভাবছিলাম।কতকিছুই যে মাথায় আসে।সবচেয়ে বেশি আসে কিছু না লেখার অজুহাত।মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে, তুমি কি আমার মতোই ক্লান্ত, এবং মাঝে মাঝে কিঞ্চিৎ বিরক্ত! কে জানে! তোমাকে জানার বা বোঝার বিশেষ চেষ্টা কোনোদিন করিনি।কি দরকার ,জীবনে করার মতো আরো কত কি আছে, কেন তোমাকে জেনে সময় নষ্ট করবো? যে ফর্মুলা ওয়ান এ আমি চলেছি,তাতে প্রতিটা পিট স্টপে শুধু এটাই ভাবতে  শেখানো  হয় যে আর কটা ল্যাপ বাকি। বরং মাঝে মাঝে চিন্তা করে দেখেছি যে তোমাকে জানার চেষ্টা করলে বিপদ বেশি।যেমন, তুমি আয়না হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে  বলবে যে আমি কেন জীবনে একটার সঙ্গে আরেকটা ভূমিকায় মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে পাল্টে নিচ্ছিনা ??? আমি বলবো,ধুত্তোর ,নিকুচি করেছে রোল প্লে এর নাটকের , আমি অফিসেও মাঝে মাঝে বাড়ির মতো,বাড়িতেও মাঝে মাঝে অফিসের মতো থাকবো, ভাববো ,হয়তো বা রিএক্ট ও করবো। ব্যালান্স করা জিমন্যাস্ট এর কাজ, আমার নয়। তুমি চুপচাপ শুনবে আর নিঃশব্দে হাসবে।আমি নিজেরই বকবকানিতে নিজে  ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ব, তুমি তো সদা জাগ্রত,ঘুমের বালাই নেই। তুমি অপেক্ষা করবে, আবার আমার জেগে ওঠার,দিন শুরু করার, কিছু ভুল শুরু করার।তুমি এক অদ্ভুত শিক্ষক, যে জ্ঞান দেয় না, সময় কে দিয়ে সময় মতো একটা থাপ্পড় কষিয়ে বুঝিয়ে দাও যে এখনো সময় আছে,শুধরে যা। সব সময় যে তোমার কথা শুনি এমন দাবি কোনোদিন করি না ,তবে চেষ্টা করি।আজ আর লিখবো না, অন্য আরেকদিন ।তোমার কথা আমার ঠিক মনে থাকবে।ও হ্যাঁ, কৈফিয়ত দেওয়ার কিছুই নেই ,তবুও বলি হঠাৎ কেন চিঠি লিখতে বসলাম,
 কারণ বহুদিন পর আবার মনে পড়ে গেল সেই অসাধারণ কথা টা," Talk to yourself at least once a day,otherwise you will miss talking to an excellent person".....ভালো থেকো,নিজের মতো।

Sunday, June 11, 2017

বমমার গিফট

ট্রান্সফারের চাকরির সবচেয়ে বিরক্তিকর জিনিস হল, দুই তিন বছর অন্তর ঘরবাড়ি চেঞ্জ করা।যতই বাজে লাগুক উপায় নেই।ব্যাজার মুখে টুটুল ,তার গল্পের বইয়ের তাক থেকে একটা একটা করে বই প্যাক বক্সে ভরা শুরু করল।বউ সামলাচ্ছে বাচ্চা কে।এরপর টুটুল ধরলে তার বউ বাকিটা গুছোবে। মুভার্স এন্ড পাকার্স রা বলেদিয়েছে যে পচ্ছন্দের জিনিস গুলো আলাদা করে রাখতে।কাল ওরা আসবে। তৃতীয় তাকের বইগুলো গুছোতে  গিয়ে কোনের দিকে একটা ছোট লাল মলাটের বইয়ের দিকে নজর গেল টুটুলের। হাতে তুলে মলাট উল্টোতেই সময় টা যেন এক ঝটকায় একুশ বছর পিছিয়ে গেল।

উনিশশো ছিয়ানব্বই সাল।জানুয়ারি মাস।ঠান্ডা ভালোই।পাড়া গাঁয়ের দিকে ঠান্ডা ভালোই পড়ে।
সকাল থেকেই বাড়িতে হইহই চলছে।আজ টুটুলের পৈতে। থার্ড জেনারেশনের একমাত্র নাতি সে। মামীমারা দূরের পুকুর থেকে কলসী তে করে জল এনেছে।এতে বেশ  কয়েকবার স্নান হবে টুটুলের ।নিচে বাড়ির সামনে একটা ছোট বেদী তৈরি।পুরুত ঠাকুর তার দলবল নিয়ে কাজ শুরু কৱেদিয়েছে।
ক্লাস ফাইভের টুটুল খালি বুঝতে পারছেনা যে এতবার স্নান করতে হবে কেন? তাও শীতকালে !!
ইয়ারকীর ও একটা সীমা থাকে।তার ওপরে ধুতি পরা। আবার নেড়া ও হতে হবে।ইস, বন্ধুরা কি আওয়াজ দেবে!!! এই চিন্তাতেই বিভোর সে।কিন্তু ভীষণ রাগী বাবা কে সে বলতেও পারছে না যে সে নেড়া হতে চায় না।কখনোই চায় না।
এইসব ভাবতে ভাবতেই গায়ে হলুদ হলো, দু তিন দফা স্নান ও হলো।কিন্তু এখনো বমমা আসছে না কেন? টুটুল সেই ভাগ্যবান দের দলে পড়ে যারা নিজেদের ঠাকুমার মা কেও দেখেছে। ঠাকুমা হলো ঠাম্মা আর ঠাকুমার মা হলো বড়মা, সহজে বমমা। আশি বছরের বমমা এখনো সোজা হয়ে হাটে, দারুন হাতের লেখা,একটাও দাঁত নেই,আর হামানদিস্তায় পান থেঁতো করে খায়। টুটুল কেও মাঝে মাঝে দেয়। কাল রাতেই এসেগেছেন তিনি ,সবাইকে বলেদিয়েছেন যে , ওই জিনিসটা টুটুলকে যেন আর কেউ গিফট না দেয়। কিন্তু ওই জিনিসটা কি টুটুল এখনো জানতে পারেনি। কেউ কেউ সাইকেল দেবে বলেছে। একগাদা লোক সকাল থেকে গল্পের বই, পেন , কিলো কিলো রবীন্দ্রনাথ,শরৎচন্দ্র,সুকুমার রায় দিয়েই যাচ্ছে।
এবার ডাক পড়লো নাপিতের কাছথেকে।টুটুলের চোখে প্রায় জল এসেইগেছে। বাবার দিকে একবার তাকালো।কোনো লাভ নেই ।পালানোর উপায় নেই।সদ্য কেনা ক্ষুর সকালের রোদে ঝকমক করে উঠলো আর একটু একটু করে টুটুলের মাথার চুল আর চোখের জল মাটিতে পড়তে থাকলো। গাড়ি প্রায় আদ্ধেক রাস্তা এসেগেছে, হটাৎ ছোটকাকুর গলার আওয়াজ, "একি, এটা কি হচ্ছে!! , বাবু একবার এদিকে তাকা তো ?" অবাক হয়ে টুটুল তাকাতেই খচাৎ, আদ্ধেক নেড়া মাথার অসহায় টুটুলের ছবি তুলে দাঁত বের করে হাসছে ছোটকাকু। দুনিয়াতে একটাও ভালো লোক আর নেই, স্থির সিদ্ধান্ত নিলো টুটুল। এরপর আরো অনেক নাটকের পর ভিক্ষা পর্ব শুরু হলো।খড়ম পরে থালা হাতে ভবতি ভিক্ষাং দেহি শুরু হলো। হাতের আংটি ,নতুন জামা প্যান্টের পিস এইসব শেষে ,টুটুল দেখলো বমমা আসছে এগিয়ে, টুটুলের বুকটা ধুকপুক করে উঠলো, না জানি কি গিফট দেবে বমমা! ফোকলা মুখে একগাল হেসে একটা ছোট্ট বইয়ের প্যাকেট দিয়ে বললো,"মালকড়ি ভেতরে আছে, রাতে দেখিস যখন বাকি বইগুলো দেখবি"।
রাত্রে সব চুকেবুকে যাওয়ার পর নিজের ঘরে একা একা শুয়ে টুটুল একএক করে সব বইগুলো দেখছে।মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হাত বুলিয়ে নিচ্ছে তার নেড়া মাথা। একটা সাদা রঙের নরম টুপি কে যেন দিয়েছে। সেটাই পরে আছে।কিন্তু বালিশে মাথা রাখলেই মনেহয় যেন ফেভিকল দিয়ে সেটে দিয়েছে কেউ।এই সব দুশ্চিন্তা সরিয়ে বমমার দেওয়া প্যাকেট টা খুললো সে, বেরোলো ছোট একটা লাল বই। মলাটে লেখা ,"শ্রীমদভাগবতগীতা" । মলাট ওল্টাতে ই পাওয়া গেল পাঁচশো একটাকা আর বমমা এর হাতে লেখা কয়েকটি লাইন,
"সুস্থ দেহ,শুদ্ধ মতি, ভোগসুখে নাহি রতি,
হও কর্মে ব্রতী,
মানুষ দেবতা হও, শ্রেয়রে জানিতে চাও,
হও মহামতি।"
--এর একটা শব্দও হয়েওঠা হয়নি টুটুলের। অনেক গুলো বছর চলে গেল বমমার পরে, স্মৃতিটুকু আজও অমলিন।

Sunday, May 14, 2017

ফোটোডিয়া


বিমলের চিরকালই শখ ছিল যে একটা ষ্টুডিও বানাবে, ঠিক বাস স্ট্যান্ডের গায়ে। তার এই আধা শহর ফুল মফঃস্বল টাউনে ষ্টুডিও তো অনেক আছে,কিন্তু লেটেষ্ট কেতা ওয়ালা, বাচ্চা ছেলে মেয়ে গুলোকে ফেসবুকের দেওয়ালে ছাপানোর মত আইডিয়া দেবে এরকম বান্দা বেশি নেই।সেই থেকে শুরু হলো "ফোটোডিয়া" ।একশো স্কয়ার ফিটের একটা গ্রাউন্ড ফ্লোর রুম ভাড়া নিয়ে।

হাসিমুখ,সর্বদাই খই ফুটছে এরকম এনার্জি নিয়ে সে কাজ শুরু করে দিলো।ব্যবসা জমে উঠতে দেরী হলো না।মাস আষ্টেক যেতে না যেতেই বিমলের মনে হলো একটা শাগরেদ খুব দরকার। দু-তিন টে অন্নপ্রাশন এর কাজ চারটে বিয়ে বাড়ীর ডাক এনে দিয়েছে।সে ভেবে দেখলো যে ক্যাবলা গোছের লোক হলেই চলে যাবে। ক্যামেরার কাজ সে একা ই ম্যানেজ করে দেবে,দরকার শুধু ব্যাগ-ট্রাইপড-লাইটস-কেবল এই সব বওয়ার জন্য একটা ছোকরা।

স্টুডিওর উল্টো দিকেই কেষ্টদার চায়ের দোকান।মাস দুয়েক হলো,একটা নতুন হেল্পার জুটেছে কেষ্টদার।অসীম ছেলেটা ভীষণ ই চুপচাপ।শান্ত মুখে হালকা হাসি লেগেই আছে।নিঃশব্দে কাজ করে যায়।কিছুতেই বলেনা  ,কোথা থেকে এসেছে,কি তার সমস্যা।কেষ্ট দা একদিন রাতে দোকান বন্ধ করার সময় দেখে যে একটা ছেলে সামনের বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছে। বাস স্ট্যান্ডে কত ভবঘুরে ই তো ওইরকম বসে থাকে।নির্বিকার চিত্তে দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যায় কেষ্ট দা।সকালে এসে দেখে একই জায়গায় ঠায় বসে আছে।কেষ্ট দার অভিজ্ঞ চোখ কিন্তু দয়ার শরীর, রেখে দিলো তাকে কাজে।বিমল চাইতে গাই গুই করেনি।শুধু বলে দিয়েছে,"খেয়াল রাখিস আর পারলে জানার চেষ্টা করিস ওর মতলব !!"

খেয়াল অবশ্যই রেখেছে বিমল। যত্ন করে কাজ শিখিয়েছে অসীম কে। দিন দিন পোক্ত হচ্ছে তার হাত। নিখুঁত থেকে নিখুঁততর হচ্ছে তার কাজ।ব্যবসা ও বাড়ছে ।  সারাদিনের হাসিমুখ থেকে হাসি শুধু মুছে যায় রাত  হলে । বিমলের এক   চিলতে ঘরের  বারান্দা তেই  শুয়ে পড়ে অসীম । চিন্তামগ্ন সে দেখে বোঝাযায় , চিন্তার তল পাওয়া যায় না। নিঃশব্দে কাজ করে চলে সে , দিনের পর দিন , বিনা বাক্যব্যয়ে ।

দেখতে দেখতে ডিসেম্বর ঢুকে গেল ।    বিয়ে  বাড়ির কাজ ,সময়ের সাথে সাথে নতুন নাটকের আবির্ভাব ঘটেছে ।বাঙালীর বিয়েতে সংগীত হচ্ছে,মেহেন্দি হচ্ছে ,বেনারসী জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে লেহেঙ্গা -চোলি কে প্রায় হামেশাই।আর একদম লেটেষ্ট আমদানি হচ্ছে বিভিন্ন পর্যায়ের ফোটোশুট । রকমারি নাম তার, ঝিনচ্যাক কাম ।বিয়ের দু-হপ্তা আগে বর  বৌ হরেক পোজে ফটো তুলবে।গড়ের ময়দানে তুললেও ব্যাকগ্রাউন্ডে  নায়াগ্রা ফলস জুড়তে হবে । লাইক বড়  বালাই ।জীবন ভীষণ রকমই ডিজিট্যাল |এরপর যাচ্ছে ওয়েডিং শুট , পোস্ট ওয়েডিং বিদাই  শুট , ইত্যাদি ।

হানিমুন শুট নিয়েও অনেক নাটক শুনেছে বিমল।তবে তার ব্যক্তিগত কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি ।এইসব নাটকে প্রাথমিক অসুবিধে হলেও ধীরে ধীরে সে বুঝে নিয়েছে যে টিকে থাকতে গেলে উপায় নেই.। অসীম সবই বোঝে কিন্তু কেন জানিনা না বিয়েবাড়ির ছবি তুলতে একদম ই চায় না ।কিন্তু মালিক কে ঘাঁটাতেও  চায় না সে ।

সিজনের  এর শেষ বিয়ে বাড়ি ।বায়নার অ্যাডভান্স এর সাথে বিয়ের কার্ড টা ও দিয়ে গেছে মেয়ের বাড়ির লোক ।রিনা ওয়েডস অর্জুন | এক ঝলকে কার্ডে চোখ বুলিয়ে নিয়েই সরে যায় অসীম ।অভ্যস্ত হাতে  গুছোতে থাকে ব্যাগ । বিমল লক্ষ্য করতে থাকে, একটু যেন দ্রুতই ব্যাগ গুছিয়ে নিলো অসীম।এই কাজের পর দিন পনেরো ছুটি নেবে বিমল।অসীম কেও বলেছে বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে । নিঃশব্দে হেসেছে অসীম । হঠাৎ একটা টুপি হাত বাড়িয়ে চেয়ে নিলো বিমলের কাছ থেকে । অসীমকে আগে কখনো টুপি   পড়তে দেখেনি বিমল ।  বেশ অন্যরকম দেখাচ্ছে তাকে।  প্রায় চেনাই যায় না ।

প্রবল ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কেটেগেলো সারাটা দিন ।এতো লোক,এতো দাবী ,এতো ভিন্ন পোজের মুখ ভ্যাংচানোর ছবি তুলতে হয়েছে যে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় ।অসীমের মুখে চোখে ক্লান্তির কোনো চিহ্ন নেই ।তেল খাওয়া মেশিনের মতো কাজ করে পড়েছে ।অবশেষে খ্যাওয়ার ডাক পড়লো ।খেতে বসতেই যাবে , হঠাৎ ইঙ্গিতে স্টুডিওর চাবিটা চাইলো অসীম ।কে জানে কি ফেলে এসেছে !একটু অবাক হলেও বিমল বিনা প্রশ্নে দিয়ে দিলো চাবি টা ।

কনে বিদায়ের সময় উপস্থিত ।হতচ্ছাড়া অসীমের দেখা নেই ।সবগুলো এঙ্গেল  থেকে দরকারি ছবি একা ম্যানেজ করতে পারছে না বিমল ।হঠাৎ দ্যাখে ,ধীর পায়ে ঢুকছে অসীম ।সামনে আসতেই এক চোট  গাল দিয়ে নিলো বিমল ।অসীমের চোখে  হাসি নেই, রাগ নেই ,আছে খালি এক অদ্ভুত শূন্যতা ।সে সব দেখার সময় ও পেলো না বিমল ।  চাপা গলায় বলল ,"মেয়ে বরের গাড়িতে  উঠছে । ক্লোজ ছবি নে কয়েকটা ঝটপট । চোখে কোল টা  ধরবি ।জল টলোমলো চোখের ছবি মেয়ের বাড়ির লোক বেশি চায় ,বুঝলি?" ঘাড় নেড়ে যন্ত্রের মতো ছবি তুলে  চলে অসীম ।

শেষ ছবিটা তোলার জন্য কনের মুখের খুব কাছাকাছি  ক্যামেরা টা নিয়ে যায় অসীম ।কনে মুখ তুলে এক ঝলক অসীম কে দেখেই চমকে যায়। এমুখ যেন তার চেনা ।কিন্তু মা-বাবার-মাসিদের কান্নায় মুহূর্তের মধ্যেই বাস্তবে  ফিরে  আসে সে । গাড়ির অন্য দিক দিয়ে তার বর ততক্ষণে উঠে পড়েছে ।হঠাৎই খেয়াল পড়ে  রিনার যে গাড়ির যেদিক দিয়ে ক্যামেরা ম্যান তার ছবি তুলছিলো,একটা হলুদ রঙের খাম ঠিক জানালার নিচের খাঁজে গোঁজা রয়েছে । আলতো করে খামটা খুলে দেখে গতরাতের তার বিয়ের মঞ্চে ওঠার ঠিক আগের মুহূর্তের ছবি ।দুহাতে ধরা পান পাতার আড়ালে অপরূপ সুন্দরী তার মুখ, অসাধারণ দক্ষতার সাথে তোলা ।নিজের কোনো ছবি দেখে কোনোদিন এতো খুশি হয়নি রিনা ।

খামের ভিতর আরেক টা ছোট্ট কাগজ ও ছিল ।সেটা খুলে দেখলো যে সেটা আট বছর আগের রিনার  লেখা একটা চিরকুট ।শহর থেকে বহুদূরের একটা গ্রামের ক্লাস টেনের ছাত্রী লিখছে ক্লাস টুয়েলভের বৃত্তি পাওয়া অনাথ ফার্স্টবয়কে ,"আমার একটা ভালো ছবি তুলে দেবে ,অসীম দা ?"


Thursday, May 11, 2017

আমি ই সেই লোক


হালকা করে গলার টাই এর নট টা দেখেনিলাম। স্যুট টা একদম ঠিকঠাক মানিয়েছে। তারপর মধুকে ফোন করলাম।মধু, আমার সেক্রেটারি কাম ম্যানেজার কাম এভরিথিং। আজ কোথায় ডাক আছে সব তার ডায়রি তেই নোট আছে।আমি অত শত মনে রাখতে পারিনা।
ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলাম।নিজের সাবজেক্ট এর বাইরে প্রায় অন্য কোনো বিষয়েই  আগ্রহ বা দক্ষতা ছিল না। কিন্তু আজকাল আমি নিজেই নিজেকে নিয়মিত অবাক করে দিচ্ছি।আন্ডার দা সান প্রায় সব কিছুই আমি জানি দেখছি।গত পরশুই তো বলে এলাম যে পূর্ব আফ্রিকার দ্বীপ গুলোতে ভারতীয় কমার্শিয়াল জাহাজ গুলোর কেন ব্যবসা করতে যাওয়া উচিত নয়। 
ওরা বলল টিআরপি নাকি হেব্বি বেড়েছে।জানেন আমার মধ্যে না  লজ্জা আর ভয় জিনিস টা একেবারে নেই,যাই বলিনা কেন সন্ধেগুলো কাটছে ভালো।পয়সা ও পাচ্ছি ভালোই।ওদের রিসার্চ টিম ই বলে দেয় যে আজ আমি ভিউয়ার দের কি খাওয়াবো। 

আত্মীয় দের বলে দিয়েছি যে আর যাই করো না কেন টিভি দেখে নিজেদের মতামত গঠন করো না ।কিন্তু তারা শুনলে তো।যদি এরা একবার জানত!! কি ঘটছে আর কে ঘটাচ্ছে পেছনে। ইংরাজি চ্যানেল গুলোতে শুনেছি বেশি মালপত্র দেয়।ভাবছি এই বয়েসে একবার ট্রাই মারব কিনা। ও হ্যাঁ, বলে ভুলে গেছি যে আমি ই সেই সবজান্তা বিশেষজ্ঞ যাকে আপনারা রোজ রাতে টিভিতে দেখেন,এনজয় করেন,পরে আলোচনা করেন,মজা পান।আমিও মজা পাই ,যখন শো শেষে চেক টা পকেটে ভরে ঠান্ডা গাড়িতে বাড়ী যাই, মজা পাই আপনাদের আগ্রহ দেখে,প্রস্তুত হই পরের দিনের জন্য। আরেকটা কথা, আমি কিন্তু একা নই।