Friday, January 26, 2018

চল, সাহস দেখাই

সকাল সকাল ই উঠে পড়লাম বুঝলি, ঠান্ডা খুব ছিল, তবুও।
--তাপ্পর?
--তাপ্পর আর কি? ঘুম থেকে উঠেই প্রথম যা করি, মোবাইল টা খুলে দেখেনিলাম কি কি মেসেজ এসেছে, কয়েকটা লাইক দিলাম, গন্ডা খানেক লাভ দিলাম, ডজন খানেক থ্যাংক উ এন্ড সেম টু ইউ এন্ড ইওর ফ্যামিলি, আর কিছু ফরওয়ার্ড কয়েকটা গ্রুপে করলাম।
-- তুই ডেলি গুড মর্নিং মেসেজ সবাই কে পাঠাস না?
--ওই বদ অভ্যেসটা এখনো ধরিনি, তবে অফিসে বসেদের বিশেষ বিশেষ দিনে পাঠাই, এই যেমন আজকে, প্রজাতন্ত্র দিবস।
-- কি মানে রে আজকের দিন টার, ডিটেইলে কখনো বুঝিনি।
-- আমি নিজের মতো একটা মানে করে নিয়েছি, ভাট শোনার টাইম আছে তো বলবো।
--বলেই ফেল।
--দেখ, ছোটবেলায় এটা ছিল খুব ভোরে উঠে স্কুলে যাওয়ার দিন।সকালে উঠে স্নান সেরে, ইউনিফর্ম পরে স্কুলে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হবে, তারপর প্যারেড হবে, গোটা শহর ঘুরব, তারপর স্কুলে ফিরে টিফিন নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। দুপুরের দিকে বন্ধুরা মিলে সিনেমা দেখতে যাওয়া।জুরাসিক পার্ক, জীবনের প্রথম সিনেমা হলে গিয়ে দেখা । তারপর বড় হলাম, কি লাভ হলো জানিনা। এখন চাকরগিরি করছি ।এখন যেকোনো দিবস ই একটা নিখাদ ছুটির দিন, যেদিন দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা যায়।
--তার মানে , প্রজাতন্ত্র দিবসের কোনো গুরুত্ব নেই?
-- কে বলেছে নেই, ফ্লিপকার্ট, আমাজন, স্ন্যাপ ডিল মিনিমাম ছাব্বিশ পার্সেন্ট ছাড় দেবে, আরো বলব গুরুত্ব নেই?? ম্যান্ডেটরি ভাবে তিরঙা,কমান্ডো, গদর, বর্ডার, এল ও সি , লক্ষ্য ইত্যাদি সব সিনেমা দেবে।যদিও আমার পার্সোনাল ফেবারিট হলো কমান্ডো। নানা পাটেকার।উফফ, কি কেলান কেলিয়েছিলো।
--আর কোনো গুরুত্বই নেই?
-- তুই কি ওই কন্সটিটুশন চালু হয়েছিল, আমার অন্য কোনো তন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্র হয়েছিলাম, সেই কবে 1950 সালে, কবে ঘি খেয়েছিলাম, আজও তার ঢেকুর উঠছে, সেই সব নিয়ে ভাবছিস?ভাই একটা কথা বল, এই দেশে কটা লোক কন্সটিটুশন বোঝে , অর্ণব আর সুমন ছাড়া? তোর কি কি অধিকার আছে সেটা যদি বাই চান্স জেনে ফেলিস তাহলেই তোর সেটা ফলাতে ইচ্ছে করবে। করবেই, গ্যারান্টি। এবার সেটা ফলাতে গেলেই আন কনস্টিটিউশনাল যা যা তুই ফেস করবি সেটা তোকে একাই সামলাতে হবে। তার থেকে আ ওয়েডনেস ডে তে নাসিরউদ্দিন যেটা বলেছিল সেটাই ভালো নয় কি,"হম লোগ ব্হত জলদি গেট ইউসড টু হো যাতে হ্যায়" ...তারপর যা করেছিল ওটা সিনেমাতেই হয়।
--- তাহলে বলছিস ভীতু হয়ে থাকাই ভালো, এভাবেই দিন কাটুক।
-- নাহ, তা কোনো? সাহস দেখাবো তো, আজ নাইট শো এর টিকিট কাটা আছে, চল পদ্মাভত দেখতে যাই ।

Saturday, November 11, 2017

সোনায় মুড়ে


ঝিঁঝি পোকার ডাক পছন্দ করেন না, এমন লোকের দলেই পড়েন বিকাশ বাবু। নভেম্বরে র দ্বিতীয় শুক্রবার, ব্যাঙ্ক এর কাজ জলদি মিটিয়ে বাড়ি ফেরার চক্করে সবাই। কিন্তু বিকাশ বাবু ক্যাশিয়ার, পাই টু পাই না মিলিয়ে বেরোনোর বান্দা নন, একটু দেরি ই হয়েগেল। খেলাপপুরের মতো এত ভেতরের দিকে গ্রাম থেকে পাঁশকুড়া স্টেশন পৌঁছানোই ঝামেলা। অন্তত কাছের বাসটেন্ড অব্দি কিভাবে পৌঁছানো যায়, ব্যাঙ্ক বন্ধ করে এইসব ই ভাবছিলেন। এমন সময় একটা ঝকঝকে টোটো নিয়ে উপস্থিত হরিয়া, ফিক ফিক করে বিড়ি টানছে। হরিশচন্দ্র দলাই কে ভালো নামে কেউই প্রায় জানেনা, একশো দিনের কাজের টাকা এসেছে কিনা জানতে প্রতি মাসে প্রায় একশবার ব্যাংকে আসে, তাই বিকাশ বাবুর চেনা।
--কি স্যার, কোথায় যাবেন? স্টেশন?
-- হ্যাঁ রে, তুই যাবি?
--নাহ, ওই বাসস্ট্যান্ড অব্দি যাবো, যাবেন?
---অন্ধের কিবা দিন কি বা রাত, চল চল।
---দাঁড়ান, আরেক টা বিড়ি ধরাই,
আরামসে দু টান মেরে টোটো চলতে শুরু করল, লালনীল এল ই ডি, কিশোরকুমার বাজছে, আর ধানক্ষেতের মাঝখান মোরামে চলছে টোটো। পাঁচ দশ মিনিট সব চুপচাপ, হটাৎ হরিয়া বলে উঠলো
--আপনার টেবিলে স্যার ওই ছবি তে বাচ্চাটা আপনার ছেলে না?
--হ্যাঁ, কেনরে?
আবার চুপ হরিয়া, বিকাশবাবু মোবাইলে  ব্যস্ত হয়ে পড়লেন । খানিক বাদে হরিয়া বললো,
--কত বয়স স্যার আপনার বাচ্চার?
--- এগারো মাস হলো, কেনরে?
আবার চুপ হরিয়া, এবারে মেজাজ হারালেন বিকাশবাবু,
-- এই শোন, যদি আমি প্রশ্ন করলে উত্তর না দিস তাহলে আর খবরদার আমাকে প্রশ্ন করবি না, চুপচাপ বাসস্ট্যান্ড এ নামিয়ে পয়সা চাইবি।
-- রাগবেননি স্যার, আমার ও ছেলের বয়স এগারো মাস।
--তো?
--- কিন্তু সে আমার কাছে নেই, আছে ,মানে অনেক দূরে আছে ।
-- কি খেয়েছিস সন্ধ্যে সন্ধ্যে, পাতা না তাড়ি??
-- না স্যার, বিড়ি ছাড়া আর কিছু টানিনা স্যার।
আচ্ছা তিন লাখ টাকা ব্যাঙ্কে রাখলে মাসে মাসে কত সুদ পাবো স্যার?
--- তোর মাথা টা কি পুরোটাই মায়ের ভোগে চলেগেছে??
-- নাহ স্যার, তবে কোনদিকে মন দিতে পারিনা আজকাল।
---কেন বলতো??
-- দু বছর আগে বিয়ে কবলাম, জানেন স্যার, পাশের গ্রাম। বউএর বাড়িতে মানেনি, পালিয়ে গিয়ে কালীঘাটে বিয়ে করলাম, তখন ভ্যান রিকশা ছিল।
-- তারপর? টোটো তে একটু এলিয়ে বসলেন বিকাশবাবু।
--গরিবের সংসার স্যার, রিকশা টেনে যা পাওয়া যায়। তবে বউ টা খুব ভালোবাসত জানেন। এই বছর একের মাসে ছেলে হলো, বউ টা বড় রোগসোগা ছিল স্যার, ওজন কম, কি বা খেতে দিতাম!! কোয়াক ডেকে বাচ্চা হলো। বাচ্চা হওয়ার দু হপ্তা বাদে বাড়িতেই মারা গেল ।বাচ্চা পাশেই শুয়ে, বিশ্বাস করুন স্যার, বাচ্চার     দিকেই তাকিয়ে ছিল, বোধহয় হাসছিল।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবার শুরু করল হরিয়া,
--নিজের বাপ মা অনেক ছোটবেলা থেকেই নেই।এক মাসি বেঁচে আছে, গেলাম নিয়ে ছেলেটাকে।তার অবস্থা আমার থেকেও খারাপ।কিন্তু আমাকে তো রোজ রিক্সা টানতে বেরোতে হবে বলুন,নইলে খাবো কি? মাসি কে বললাম শুধু দিনের বেলাটা দেখো, সন্ধ্যে নামলেই ফিরে আসবো।মা মরা ছেলে টা কে সেদিনের মতো নিয়ে নিলো জানেন স্যার। কিন্তু বেশি দিন রাখাগেল না জানেন, মাসির এক ছেলে, পাঁচ বছর বিয়ে হয়েছে ,এক টাও ছেলেপুলে আসেনি।কি রাগ আমার ওই এক রত্তি বাচ্চার উপর!! রাখতে দিলো না স্যার, নিয়ে চলে এলাম, আবার এর ওর তার বাড়ি। একদিন রাতে ছেলের কান্না সহ্য করতে না পেরে খুব জোরে  আট দশ টা চড় মারলাম। কচি পা দুটো যেন লাল হয়ে  ফেটে ফেটে গেল।আমাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরল জানেন স্যার।
---ওই টুকু শিশুকে তুই মারলি?
---ভীষণ রাগ  ধরে গেছিলো নিজের ওপর স্যার, কাতান দিয়ে নিজের হাত কেটে ফেলতে গেছিলাম। রতন দা দেখতে পেয়ে ছুটে এসে আটকায়। রতন দা কে চেনেন তো স্যার?
--হুঁ,---চাষের জমিজমার, কৃষি লোনের দালাল রতন কে  বিকাশবাবু ভালোই চেনেন।
---রতন পরের দিন সকালে আমার ছেলেকে তার বাড়িতে রাখতে নিয়েগেল। বৌদিও দেখবে বললো ।একটু নিশ্চিন্ত হলাম স্যার। কিন্তু সেটা কয়েক দিন।ক
---তারপর??
-- দিন দশেক যেতেই, এক রাতে রতন দা খেতে ডাকলো আমাকে, খেতে খেতে বললো,"তুই একা ওই টুকু বাচ্চাকে পারবিনা বড় করতে, ওকে যে মানুষ করতে পারবে তাকে দিয়েদে।" হাতের খাওয়ার আর মুখ পর্যন্ত পৌছল না স্যার।
--চিৎকার করে বললাম, "আমার ছেলে কে দিয়েদাও, এখুনি ।"
---নিয়ে যা, ওই ঘরে ঘুমিয়ে আছে,কিন্তু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখিস, তুই পারবি না ঐটুকু ছেলে কে এক মানুষ করতে। তিন কূলে  কে আছে তোর ? আবার বিয়ে করবি? কর। সৎমা দেখবে তোর ছেলে কে? নিজের অবস্থা দেখেছিস? আমার কথা শোন, আমার চেনা লোক আছে, বোম্বে থেকে আসছে পরশু। দিয়েদে। ফোকোটে নয়। নগদ পাঁচ লাখ পাবি। কোনোদিন স্বপ্নেও দেখেছিস হতভাগা??  জীবন পাল্টে যাবে।
---তুই, তুই নিজের ছেলে কে বেচে দিলি?
---সারারাত কাঁদলাম স্যার আর ভাবলাম ওরা কি আমার ছেলে কে ভালো রাখতে পারবে??, একদিন বাদে একটা বড় গাড়িতে করে এক স্বামী-স্ত্রী আর একজন আয়া এলো, হিন্দিতে কথা বলছিল।বড়লোক দেখেই বোঝাযায়।।  মোবাইল খুলে ছবি দেখে আমার ছেলেকে  মিলিয়ে নিলো। দেখি ভদ্রলোকের স্ত্রী একটা বিরাট ব্যাগ থেকে ধবধবে সাদা তোয়ালে বের করলো। তোয়ালের ভেতর দেখি অনেকগুলো সোনার চেন,আরো গয়না আছে।সবচেয়ে সুন্দর চেন টা আমার ছেলের গলায় পরিয়ে তাকে তোয়ালে জড়িয়ে কোলে তুলে আমাকে নমস্তে করলো। ভদ্রলোক রতন দার সাথে কথা বলছিলেন।এসে আমাকে বললেন, যখন ইচ্ছে হবে ছেলে কে দেখতে পাবে,একটাই শর্ত, পরিচয় দেওয়া যাবে না। পুরো নগদ দিয়েগেল স্যার।
--তোর পাড়ায় কেউ কিছু বললো না?
--- সারারাত ফিস্ট হলো স্যার পাড়ায়।সবাই আমার ভাগ্যকে আজ হিংসে করছে । এই টোটো টা কিনলাম। আর বাকি টাকা আপনার সিটের তলায় আছে।আপনি বলে বললাম। এই নিন স্যার, বাসস্ট্যান্ড এসেগেছে।
--- নিজের ওপর ঘেন্না করে না তোর?একটা কষ্ট যেন গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে বিকাশ বাবুর।
--জানিনা। খালি রাতে ঘুম আসে না। চোখ বুঝলেই দেখি ওরা আমার ছেলেকে নিয়ে চলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, সোনায় মুড়ে ।

Saturday, September 16, 2017

খুনসুটি

সারাদিন খাটা খাটুনির পর অফিস থেকে ফিরে একটু হাত পা ছড়িয়ে ফ্যান এর তলায় বসলো অসিত। লাস্ট দু সপ্তাহ খুব হেক্টিক গেছে। প্রমোশন তারপর বদলি, নতুন শহর, আবার একটা ঠিক ঠাক বাড়ী ভাড়ার জন্য খোঁজা, এক ঘর জিনিস পত্র সরানো, খুব ধকল যাচ্ছে। এইসব ভাবতে ভাবতে রেগুলেটর টা একটু বাড়াতে গেল অসিত, আর ব্যাস, লোডশেডিং।
---ধুর শালা, কপাল টাই খারাপ।
--" তাই হবে, তুমি আজও ইনভার্টার এর কানেকশন টা ঠিক করলে না, "...টর্চ নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠলো শ্রাবণী।
-- সারাদিন কাজের পর আর কিচকিচ করো না তো, আমারো তো একটা সীমা আছে নাকি, কতোদিক কত তাড়াতাড়ি সামলাবো ??
-- তুমি একাই সব সামলাও ?? সারাদিন ধরে আমি ঘরে থাকি বলে কি কিছুই করিনা বলতে চাও?একটা ছুটির দিন শুধু তোমার ছেলেটা কে ,এক বেলা সামলে দেখাও , বাকি ঘরের কাজ বাদ ই দিলাম ,তারপর মেজাজ দেখাবে।
দুঃস্বপ্নেও জেতা যাবে না, এরকম যুদ্ধে না নামাই ভালো। ডিসকভারি তে মাঝে মাঝেই দেখায় স্বয়ং বিশালাকায় সিংহ মামাও সিংহী র দাবড়ানি এর সামনে ল্যাজ গুটিয়ে বসে পড়ে, তো অসিত কোন ছারপোকা !!!
পাশের রুমে ছোটা শাকিল ততক্ষনে দুষ্টুমি ভুলে অন্ধকারে চিল চিৎকার জুড়েছে। প্রায়োরিটি সেট করা হয়ে গেল। শাউটিং কিড না ক্ষুব্ধ বউ । প্রথম টাই শান্ত করা জরুরি। চুপচাপ বাচ্চা কে কোলে করে ছোট্ট ব্যালকনিতে চলে যায় অসিত। আর দিন দুয়েক বাদেই পূর্ণিমা।অনেক টা চাঁদের আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। বউ চুপচাপ ব্যালকনির আরেক কোনে দাঁড়িয়ে। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অসিত হঠাৎ বলে উঠলো,
--- আমার চশমা কোন ক্লাসে লেগেছিল জানো??
-- না, তাতে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে?
-- তাও ঠিক। আচ্ছা, বাদ দাও।
‌খুব ই পুরোনো ট্রিক।কিন্তু দরকারে খুব কাজে দেয়।কিউরিওসিটির সলতে পাকিয়ে ছেড়ে  দাও।
--কি হলো, বলবে??
--- কি বলবো?
-- ন্যাকামো তুমিও কম করো না। তোমার চশমার গল্প।
-- ওহ, ওই টা কিছুনা।
-- তুমি বলবে,  হ্যাঁ কি না ?
--বলছি বলছি, আমার চশমা লেগেছিল ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে ওঠার সময়।লোডশেডিং এর জন্য।
-- মানে?
-- মানে আর কি? তখন তো আর ব্যাটারী, ইনভার্টার ছিল না, মানে আমার বাবা তখন ও এনে দিতে পারে নি। তো হারিকেন ই ভরসা।
-- তার সঙ্গে চশমার কি ??
-- কিছুই না, হোম টাস্ক ক্যান ওয়েট, চাচা চৌধুরী, বিল্লু, পিঙ্কি, সাবু , রাকা কান্ট। যত খুদে খুদে লেখাই হোক, যত কম আলোই হোক, পড়ে ফেলতেই হবে। আমাদের বাবু বোধহয় এই সব আর পড়বে না বলো,   বড়ো হয়ে??
-- কে জানে!!মোবাইল, কিন্ডল, ট্যাব কত কি এসেগেছে,বই হাতে নিয়ে পড়ার কি দরকার!! আমার চাঁদমামার একটা বিশাল কালেকশন ছিল জানো, পুজোতে বাপের বাড়ি গেলে পুরোনো আলমারি গুলো ঝেড়ে দেখতে হবে।
-- বা বা, তুমি এতদিন বলোনি তো?
--তুমিও কি বলেছিলে যে কমিকস পড়ে পড়ে তোমার চোখে চশমা লেগেছিল??
-- শোধবোধ, ওকে? তুমি হারিকেন এর কাচ পরিস্কার করে কেরোসিন ভরে ঠিক ঠাক জ্বালাতে পারবে? আমি পারতাম । কেরোসিনের একটা অদ্ভুত দারুন গন্ধ হয় , যেটা ছোট বেলায় কেন জানিনা খুব ভালো লাগতো। আমি মেঝেতে বসে হারিকেন ঠিক ঠাক ফিটিং করতাম, আর আর ঠাম্মা পান চিবোতে চিবোতে মাঝে মাঝে সেই সময় ই ভূতের গল্প বলতো। আজকাল আর কেউ গল্প বলে না বলো, সবাই গল্প ফরওয়ার্ড করে।
-- তাই হবে, এই সব বাজে কথা ছেড়ে উঠবে, বাচ্চা টা ঘুমিয়ে গেল যে!!
-- হ্যাঁ, এনাকে ন্যাপি পরিয়ে যথাস্থানে সেট করে দিতে হবে  দেখছি, একটু ধরো দেখি। এই দেখ,
 কারেন্ট ও এসেগেল। যাক বাবা , শান্তি ।
-- হ্যাঁ, তোমার ওই সব ভাট বকা থেকেও শান্তি দাও। তাড়াতাড়ি ডিনার টা সেরে আমাকে উদ্ধার করো।
-- তুমি না খুব আনরোমান্টিক, বুঝলে?
-- তুমিও না খুব  প্যাথেটিক  , কাল যেন ইনভার্টার টা লোক এসে সারিয়ে দিয়ে যায়, বুঝলে??



Monday, August 28, 2017

অথ শস্য কথা


‌"এমন বসন্ত দিনে, বাড়ী ফেরো মাংস কিনে, বারোয়ারি ডাস্টবিনে জমে ওঠে ....." গুনগুন করতে করতে বিভুবাবুর মনে হল ,ধুর শালা ,এটা তো অগাস্ট মাস, বসন্ত কোত্থেকে আসবে??বহুদিন বাদে একটা ক্যাজুয়াল লিভ মেরেছেন বিভুবাবু, এই বছরে এই প্রথম, গিন্নি খুশ, দারুন গন্ধ ভেসে আসছে রান্না ঘর থেকে। বিভুবাবু মহা অলস লোক, ছুটি নিয়ে সারাদিন বাড়িতেই থাকবেন, সারাদিনে কিছু না খেতে দিলেও পরোয়া নেই, ল্যাদ খেয়ে কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু, ভাগ্য এতটাও প্রসন্ন নয়, গিন্নির হুকুম, বসে বসে তো মোটা হচ্ছ, আনন্দবাজার চেবানো শেষ হলে যাও না একটু মাছ বাজারে, বৃষ্টি হচ্ছে, ভাবছি খিচুড়ি করবো, সঙ্গে তো কিছু লাগবে নাকি??

অগত্যা পাশের ফ্লাট এর অভি বাবু কে নিয়ে চললেন কোতোয়ালি বাজারে, অলস লোকেরা সাধারণত বুদ্ধিমান হয়, কাছের বাজার টা  অন্তত চিনে রাখতেই হয়।বাজারের শুরু থেকেই প্রত্যেক মাছ ওলার একটাই চিৎকার, "দাদা পাঁচশোর মাল চারশয়, শুধু আপনার জন্য সাড়ে তিনশোয়, আপনি তো রেগুলার নেন দাদা, আপনাকে আর কি বলবো!!" বিভূবাবু তিন মাস বাদে এই বাজারে এলেন।যাই  হোক, আরো এগিয়ে চললেন ।
অভি বাবু পোড়খাওয়া বিষয়ী মানুষ, প্রায় কাকার বয়সি, তার সাবধানবাণী ,"নিজে টিপে দেখে পরখ   না করে কিছু নেবে না, বৌমা বলেই দিয়েছে যে তোমার মতো ন্যলা কেবলা লোক বিরল, একটু দেখে কিনবে,"।  রাগে গা হাত পা জ্বলে গেলেও উপায় নেই। অভিবাবু এক জন প্রকৃতই শুভানুধ্যায়ী। সাত পাঁচ আর না ভেবে ইলিশ সমুদ্রে ডুব দিলেন বিভু বাবু। সরু ইলিশ, মোটা ইলিশ, রোগা ইলিশ ,চওড়া ইলিশ,বুড়ো ইলিশ, খোকা ইলিশ, দীঘার ইলিশ, কোলাঘাটের ইলিশ, পালিশ করা ইলিশ আবার বালিশের মতো ইলিশ। বিভু বাবুর চোখ বড়বড় হয়ে যাচ্ছে এটা ভেবে যে এই সবের ই সদগতি হবে, ঝোলে হবে, ঝালে হবে , অম্বলে বা টকে হবে , আরো চাইলে ভাপে হবে , দিবে শুধু  দিবে, মিলাবে মিলিবে , যাবে না কেহই ফিরে।

গোটা বাজার ঘোরা হয়ে গেল।এবার কিনতেই হবে, কানকোর ঠিক তলায় একটু টিপে দেখে নিলেন, নাহ, বেশ শক্ত পোক্তই মনে হচ্ছে, দাও ভাই এটাই কেটে দাও। ঠিক ঠাক পিস কোরো ভাই, নয়তো আমার  পিস নষ্ট হয়ে যাবে। অভি বাবু একটু বিজ্ঞের হাসি দিলেন,আর মনে মনে বললেন"আজকালকার ছোকরা, গুছিয়ে বাজার করার যে আনন্দ কতটা , কি আর বুঝবে!" ফিচকে মাছ ওলা ও কম যায় না, কাটতে কাটতেই বলে উঠলো," এমন মাছ দিচ্ছিনা দাদা, দেখবেন বৌদি নিজেই মাছ ছাড়িয়ে আপনাকে খাইয়ে দেবেন"। আর বিভুবাবুর ও মনে পড়ে গেল ঠিক বিয়ের আগের বছর এর কথা,দুই বাড়িতেই সব জানাজানি হয়েগেছে, খালি ডেট ফাইনাল করা বাকি,এমন সময় একদিন ডিনার এ নেমন্তন্ন হবু শ্বশুর বাড়িতে। খাসী মাংসের সাথে ইলিশের ঝাল ও আছে। ইলিশ পছন্দের মাছ হলেও কাঁটা টা ঠিক ম্যানেজ করতে পারেন না বিভু বাবু, তাই ইলিশ ভাজা ই বেশি পছন্দ। পড়ে গেলেন মহা  বেকায়দায়। হবু শালী দের সামনে, বউ এর মাসী দের সামনে চূড়ান্ত কেস খাওয়া। অবশেষে উদ্ধারে সেই অর্ধাঙ্গিনী  । প্রতিজ্ঞা করেছিলেন বিভুবাবু যে পরের জামাই ষষ্ঠী তে দেখিয়ে দেবেন যে তিনি কত এক্সপার্ট কাঁটা ছাড়াতে , দরকার হলে কাঁটা চামচ দিয়েও কাঁটা ছাড়ানো শিখে নেবেন।

সাত বছরের পুরোনো ছেলেমানুষির কথা ভেবে নিজেই একটু হেসে নেন । ইলিশ ততক্ষণে মাছের ব্যাগ এ ঢুকে পড়েছে। তারপর পকেট হালকা আর মন আনন্দে পূর্ণ করে , অভি বাবুর দিকে তাকিয়ে  বিভু বলেন,"চলুন দাদা ,এবার বাড়ি ফেরা যাক"  ....

Saturday, July 8, 2017

ক্যারম

~~"আমি ডান দিকের সিঁড়িটা দিয়ে উঠে যাচ্ছি অনীশ, তুই আমাকে কভার কর,"হিস হিসিয়ে কথাটা বলেই নিঃশব্দে উঠেগেল রোহিত।জার্মান মাউজার এর লক টা আরেকবার দেখেনিল অনীশ।এরকম কভার্ট অপারেশন নতুন নয়,আট বছর হয়েগেলো ফোর্স এ ,তবুও বেসিকস ঠিক  রাখতেই হয়। পাক্কা ইনফরমেশন আছে, কিছু এক্সট্রিমিস্ট এই বিল্ডিং এরই পাঁচ তলায় আছে।আরেক টা ফ্লোর উঠে ডান দিকে ঘুরতেই কপালে জোর একটা আঘাত, তারপর ই সব ব্ল্যাক আউট।

জ্ঞান ফিরতে দেখলো, ওপর থেকে ঝুলিয়ে রাখা আছে তাকে।লোহার রড লাল  করে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে অনীশ এর দিকে, দাতে দাঁত চেপে অনীশ অপেক্ষা করতে থাকলো টর্চারের। মরে যাবে তবু মুখ খুলবে না,এ ট্রেনিং নেওয়া আছে,আজ পরীক্ষার দিন।রোহিত  টা যে কোথায় গেল!!!আবার যখন জ্ঞান ফিরলো,আর্মি হসপিটাল এ শুয়ে আছে অনীশ।খালি কোমরের তলায় সাড় নেই।ডাক্তার বলেগেলেন ,"সরি ফর ইওর লস মাই ব্রেভ সন, ইউ ডিড এ গ্রেট সার্ভিস টু ইওর কান্ট্রি,ইওর ফোর্স"!!! ম্লান হাসি খেলে গেল অনীশ এর মুখে।ওই তো একটা খালি হুইল চেয়ার নিয়ে ঢুকছে রোহিত আর   রিয়া। হৃদপিন্ড টা যেন এক সেকেন্ড এর জন্য থমকে গেল ,তবে কি যা শুনেছিল সবই সত্যি !!! ব্যথার ভান করে চোখ বুজল অনীশ।আর কারুর কোনো কথাই শুনতে ইচ্ছে করছে না।

এক বছর কেটে গেছে।রোহিত এর প্রতিপত্তি, লিডারশিপ এবিলিটি তে সবাই মুগ্ধ।সবচেয়ে বড় কথা , ডিরেক্ট কমব্যাট থেকে ট্রান্সফার হয়ে টেক ডিপার্টমেন্ট এর হেড অনীশ অব্দি তার সাপর্টে, রোহিতের চিফ অফ ডিপার্টমেন্ট হওয়া আটকায় কে? টেক ডিপার্টমেন্ট এর ছোট্ট ঘরটাই অনীশ এর সব।অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়াও রয়েছে একটা বিরাট ম্যাচ বোর্ড, ক্যারম এর। ইউনিভার্সিটি চ্যাম্পিয়ন ছিল অনীশ।এখনো ক্যারম এর স্ট্রাইকার তার নিঃসঙ্গতাকে ভরসা দেয়।শুধু রোহিত কে সে টাচ করতে দেয় ওই বোর্ড টা। আজ একটা অপারেশন এর পর ফিরলো রোহিত,শুট এট সাইট এনকাউন্টার অর্ডার ছিল। একটা গুলি ডান হাত ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে।ছুটতে ছুটতে ঢুকে পড়লো, অনীশ এর চেম্বার এ।জামাখুলে ব্যাণ্ডেজ বাঁধতে বসলো।অনীশ চুপ চাপ গুটি সাজাচ্ছিলো বোর্ডে।দেখলো নতুন ট্যাটু করিয়েছেন রোহিত বাবু,ডান কোমরের কাছ থেকে পেট অব্দি সিংহের মুখ।সিক্স প্যাক চেহারায় ভালোই খুলেছে ব্যাপার টা।ম্যাচ শুরু হতেই মুচকি হেসে অনীশ বলল,"একটা পুরোনো সমস্যা সলভ হয়েছে।জেনে গেছি আমাকে সেই টর্চারের পেছনে কে ছিল। মুড ভালো আছে, তোকে আজ সেঞ্চুরি বোর্ড মারবো।বলেই স্ট্রাইক।হিটে ই চার গুটি গেল। লাস্ট গুটি টা ফেলার সময় দেখলো ঠিক অপজিট এঙ্গেলে বোর্ডের ডায়াগোনালি দাঁড়িয়ে রোহিত, মুখ হাঁ করে দেখছে জিনিয়াস অন হুইলস এর খেলা।অনীশ বলল,রোহিত ঐখানেই দাড়া, তোকে চটকা শট দেখাই।বলেই ডান হাতের মধ্যমা আর বুড়ো আঙ্গুল এরমাঝে স্ট্রাইকার বসিয়ে অদ্ভুত ভাবে একটা হিট করলো নিজের বেসে এ।স্ট্রাইকার কোনাকুনি ছিটকে গিয়ে রোহিতের সামনের পকেটে গিয়ে ফেলেদিল শেষগুটি।এক মুহূর্তের জন্য যেন চিনচিনে ব্যাথা পেলো রোহিত, পর মুহূর্তেই সব ঠিক।আস্তে আস্তে খালি বোর্ডের উপরে একটা কার্ড রাখে রোহিত।তার আর রিয়া এর বিয়ে।প্রথম ইনভাইট অনীশ কে।পুরোনো স্মৃতি যেন চলকে ওঠে চোখের সামনে।বেস্ট উইশ জানিয়ে অল্প হাসে অনীশ।পরের দিন সকালেই খবর আসে অফিস এ। নিজের বাথরুমের ভেতর রোহিতের ডেড বডি পাওয়া গেছে। পোস্টমর্টেম এ জানা যায় বিষক্রিয়ায় মৃত্য।তার মোবাইল ট্র্যাক করে দেখাগেল এনকাউন্টার এর পরে  অনেকগুলো বার এ সেই রাতে রোহিত ঢুকেছিলো অফিস ফেরার আগে।নেশা হিসেবে মাঝে মধ্যে ইনজেকশন নিতো রোহিত, বাঁ হাতে ইনজেকশন এর দাগ ও ছিল।গোটা শরীর  জুড়ে ট্যাটু।সেটাই কি কাল হলো??

আরও ছয়মাস কেটে গেল।নতুন চিফ অফ ডিপার্টমেন্ট এর ট্রান্সফার এর জন্য ফেয়ার ওয়েল নিচ্ছে অনীশ।মুম্বাই চলে যাচ্ছে সে।হুইলচেয়ার তার কাজের ক্ষেত্রে উন্নতিতে বাধা হতে পারেনি। সবাই কে ধন্যবাদ জানিয়ে সে বললো যে সে চলে যাওয়ার পর যেন তার বন্ধুর স্মৃতিতে ওই ক্যারম বোর্ডে আর কেউ না খেলে।পাতলা প্লাষ্টিক কভার একটা চাপিয়ে চলে যায় সে।

নতুন বাচ্চা সুমিত  জয়েন করেছে। সে নাকি দারুন ক্যারম খেলে।সবাইতাকে পুরনো গল্প শোনায়। থাকতে না পেরে একদিন   সেই বোর্ডের কভার খুলে সে  আনমনে  হাত বুলোতে থাকে।এত সুন্দর পালিশ করা ম্যাচ বোর্ড।আর কেউ খেলে না এটায়! কি দুর্ভাগ্য! হটাৎ ই একটা পকেটের পাশে হাত দিতেই মনে হয় কেউ যেন  একটা চিমটি কাটলো । সুইচ টা দেখতে পায়নি সুমিত ,যেখানে বলে বলে হিট করতো অনীশ এর স্ট্রাইকার, বিষ মাখানো নিডল টা চোখের পলকে বোর্ড এর সেই পকেটের বাইরের দিক থেকে বেরিয়ে সুমিতের ডান কোমরে ছুঁয়ে আবার ভেতরে ঢুকে যায় ~~~~~