Saturday, November 11, 2017

সোনায় মুড়ে


ঝিঁঝি পোকার ডাক পছন্দ করেন না, এমন লোকের দলেই পড়েন বিকাশ বাবু। নভেম্বরে র দ্বিতীয় শুক্রবার, ব্যাঙ্ক এর কাজ জলদি মিটিয়ে বাড়ি ফেরার চক্করে সবাই। কিন্তু বিকাশ বাবু ক্যাশিয়ার, পাই টু পাই না মিলিয়ে বেরোনোর বান্দা নন, একটু দেরি ই হয়েগেল। খেলাপপুরের মতো এত ভেতরের দিকে গ্রাম থেকে পাঁশকুড়া স্টেশন পৌঁছানোই ঝামেলা। অন্তত কাছের বাসটেন্ড অব্দি কিভাবে পৌঁছানো যায়, ব্যাঙ্ক বন্ধ করে এইসব ই ভাবছিলেন। এমন সময় একটা ঝকঝকে টোটো নিয়ে উপস্থিত হরিয়া, ফিক ফিক করে বিড়ি টানছে। হরিশচন্দ্র দলাই কে ভালো নামে কেউই প্রায় জানেনা, একশো দিনের কাজের টাকা এসেছে কিনা জানতে প্রতি মাসে প্রায় একশবার ব্যাংকে আসে, তাই বিকাশ বাবুর চেনা।
--কি স্যার, কোথায় যাবেন? স্টেশন?
-- হ্যাঁ রে, তুই যাবি?
--নাহ, ওই বাসস্ট্যান্ড অব্দি যাবো, যাবেন?
---অন্ধের কিবা দিন কি বা রাত, চল চল।
---দাঁড়ান, আরেক টা বিড়ি ধরাই,
আরামসে দু টান মেরে টোটো চলতে শুরু করল, লালনীল এল ই ডি, কিশোরকুমার বাজছে, আর ধানক্ষেতের মাঝখান মোরামে চলছে টোটো। পাঁচ দশ মিনিট সব চুপচাপ, হটাৎ হরিয়া বলে উঠলো
--আপনার টেবিলে স্যার ওই ছবি তে বাচ্চাটা আপনার ছেলে না?
--হ্যাঁ, কেনরে?
আবার চুপ হরিয়া, বিকাশবাবু মোবাইলে  ব্যস্ত হয়ে পড়লেন । খানিক বাদে হরিয়া বললো,
--কত বয়স স্যার আপনার বাচ্চার?
--- এগারো মাস হলো, কেনরে?
আবার চুপ হরিয়া, এবারে মেজাজ হারালেন বিকাশবাবু,
-- এই শোন, যদি আমি প্রশ্ন করলে উত্তর না দিস তাহলে আর খবরদার আমাকে প্রশ্ন করবি না, চুপচাপ বাসস্ট্যান্ড এ নামিয়ে পয়সা চাইবি।
-- রাগবেননি স্যার, আমার ও ছেলের বয়স এগারো মাস।
--তো?
--- কিন্তু সে আমার কাছে নেই, আছে ,মানে অনেক দূরে আছে ।
-- কি খেয়েছিস সন্ধ্যে সন্ধ্যে, পাতা না তাড়ি??
-- না স্যার, বিড়ি ছাড়া আর কিছু টানিনা স্যার।
আচ্ছা তিন লাখ টাকা ব্যাঙ্কে রাখলে মাসে মাসে কত সুদ পাবো স্যার?
--- তোর মাথা টা কি পুরোটাই মায়ের ভোগে চলেগেছে??
-- নাহ স্যার, তবে কোনদিকে মন দিতে পারিনা আজকাল।
---কেন বলতো??
-- দু বছর আগে বিয়ে কবলাম, জানেন স্যার, পাশের গ্রাম। বউএর বাড়িতে মানেনি, পালিয়ে গিয়ে কালীঘাটে বিয়ে করলাম, তখন ভ্যান রিকশা ছিল।
-- তারপর? টোটো তে একটু এলিয়ে বসলেন বিকাশবাবু।
--গরিবের সংসার স্যার, রিকশা টেনে যা পাওয়া যায়। তবে বউ টা খুব ভালোবাসত জানেন। এই বছর একের মাসে ছেলে হলো, বউ টা বড় রোগসোগা ছিল স্যার, ওজন কম, কি বা খেতে দিতাম!! কোয়াক ডেকে বাচ্চা হলো। বাচ্চা হওয়ার দু হপ্তা বাদে বাড়িতেই মারা গেল ।বাচ্চা পাশেই শুয়ে, বিশ্বাস করুন স্যার, বাচ্চার     দিকেই তাকিয়ে ছিল, বোধহয় হাসছিল।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবার শুরু করল হরিয়া,
--নিজের বাপ মা অনেক ছোটবেলা থেকেই নেই।এক মাসি বেঁচে আছে, গেলাম নিয়ে ছেলেটাকে।তার অবস্থা আমার থেকেও খারাপ।কিন্তু আমাকে তো রোজ রিক্সা টানতে বেরোতে হবে বলুন,নইলে খাবো কি? মাসি কে বললাম শুধু দিনের বেলাটা দেখো, সন্ধ্যে নামলেই ফিরে আসবো।মা মরা ছেলে টা কে সেদিনের মতো নিয়ে নিলো জানেন স্যার। কিন্তু বেশি দিন রাখাগেল না জানেন, মাসির এক ছেলে, পাঁচ বছর বিয়ে হয়েছে ,এক টাও ছেলেপুলে আসেনি।কি রাগ আমার ওই এক রত্তি বাচ্চার উপর!! রাখতে দিলো না স্যার, নিয়ে চলে এলাম, আবার এর ওর তার বাড়ি। একদিন রাতে ছেলের কান্না সহ্য করতে না পেরে খুব জোরে  আট দশ টা চড় মারলাম। কচি পা দুটো যেন লাল হয়ে  ফেটে ফেটে গেল।আমাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরল জানেন স্যার।
---ওই টুকু শিশুকে তুই মারলি?
---ভীষণ রাগ  ধরে গেছিলো নিজের ওপর স্যার, কাতান দিয়ে নিজের হাত কেটে ফেলতে গেছিলাম। রতন দা দেখতে পেয়ে ছুটে এসে আটকায়। রতন দা কে চেনেন তো স্যার?
--হুঁ,---চাষের জমিজমার, কৃষি লোনের দালাল রতন কে  বিকাশবাবু ভালোই চেনেন।
---রতন পরের দিন সকালে আমার ছেলেকে তার বাড়িতে রাখতে নিয়েগেল। বৌদিও দেখবে বললো ।একটু নিশ্চিন্ত হলাম স্যার। কিন্তু সেটা কয়েক দিন।ক
---তারপর??
-- দিন দশেক যেতেই, এক রাতে রতন দা খেতে ডাকলো আমাকে, খেতে খেতে বললো,"তুই একা ওই টুকু বাচ্চাকে পারবিনা বড় করতে, ওকে যে মানুষ করতে পারবে তাকে দিয়েদে।" হাতের খাওয়ার আর মুখ পর্যন্ত পৌছল না স্যার।
--চিৎকার করে বললাম, "আমার ছেলে কে দিয়েদাও, এখুনি ।"
---নিয়ে যা, ওই ঘরে ঘুমিয়ে আছে,কিন্তু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখিস, তুই পারবি না ঐটুকু ছেলে কে এক মানুষ করতে। তিন কূলে  কে আছে তোর ? আবার বিয়ে করবি? কর। সৎমা দেখবে তোর ছেলে কে? নিজের অবস্থা দেখেছিস? আমার কথা শোন, আমার চেনা লোক আছে, বোম্বে থেকে আসছে পরশু। দিয়েদে। ফোকোটে নয়। নগদ পাঁচ লাখ পাবি। কোনোদিন স্বপ্নেও দেখেছিস হতভাগা??  জীবন পাল্টে যাবে।
---তুই, তুই নিজের ছেলে কে বেচে দিলি?
---সারারাত কাঁদলাম স্যার আর ভাবলাম ওরা কি আমার ছেলে কে ভালো রাখতে পারবে??, একদিন বাদে একটা বড় গাড়িতে করে এক স্বামী-স্ত্রী আর একজন আয়া এলো, হিন্দিতে কথা বলছিল।বড়লোক দেখেই বোঝাযায়।।  মোবাইল খুলে ছবি দেখে আমার ছেলেকে  মিলিয়ে নিলো। দেখি ভদ্রলোকের স্ত্রী একটা বিরাট ব্যাগ থেকে ধবধবে সাদা তোয়ালে বের করলো। তোয়ালের ভেতর দেখি অনেকগুলো সোনার চেন,আরো গয়না আছে।সবচেয়ে সুন্দর চেন টা আমার ছেলের গলায় পরিয়ে তাকে তোয়ালে জড়িয়ে কোলে তুলে আমাকে নমস্তে করলো। ভদ্রলোক রতন দার সাথে কথা বলছিলেন।এসে আমাকে বললেন, যখন ইচ্ছে হবে ছেলে কে দেখতে পাবে,একটাই শর্ত, পরিচয় দেওয়া যাবে না। পুরো নগদ দিয়েগেল স্যার।
--তোর পাড়ায় কেউ কিছু বললো না?
--- সারারাত ফিস্ট হলো স্যার পাড়ায়।সবাই আমার ভাগ্যকে আজ হিংসে করছে । এই টোটো টা কিনলাম। আর বাকি টাকা আপনার সিটের তলায় আছে।আপনি বলে বললাম। এই নিন স্যার, বাসস্ট্যান্ড এসেগেছে।
--- নিজের ওপর ঘেন্না করে না তোর?একটা কষ্ট যেন গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে বিকাশ বাবুর।
--জানিনা। খালি রাতে ঘুম আসে না। চোখ বুঝলেই দেখি ওরা আমার ছেলেকে নিয়ে চলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, সোনায় মুড়ে ।